-->

হ্রদের দেশে পানির কষ্ট!

অরণ্য জুয়েল, রাঙামাটি
হ্রদের দেশে পানির কষ্ট!

রাঙামাটির ‘কাপ্তাই লেক’ এশিয়ার বৃহত্তম মিষ্টি পানির কৃত্রিম হ্রদ। জেলা সদরের সঙ্গে ছয় উপজেলার যোগাযোগের মাধ্যম ৭২৫ বর্গকিলোমিটারের এই হ্রদ। এ জলের ওপর চলে জেলার বেশিরভাগ মানুষের জীবিকা। তবুও হ্রদের দেশে পাহাড়ের মানুষের যেন পানির কষ্টই বেশি। পানির জন্য কয়েক কিলোমিটার চড়াই-উতরাই পার করতে হয় স্থানীয়দের।

কাপ্তাই হ্রদের সঙ্গে যুক্ত উপজেলাগুলোর মানুষ হ্রদের পানি পান ও ব্যবহার করে থাকে। প্রাকৃতিক এসব পানির উৎস থেকে পানি পান করে মানুষ পানিবাহিত নানা রোগে ভুগছেন। প্রাণহানির ঘটনাও ঘটছে প্রায়শই।

পাহাড়ে পানির সংকট শুরু হয় শীত মৌসুম থেকেই। ডিসেম্বর থেকে মে পর্যন্ত এই ছয় মাস চলে কষ্টে। এ সময়টাতে ছড়া, ঝরনা, কুয়া শুকিয়ে যায়। বর্ষার আগ পর্যন্ত সংকট থাকে পানীয় জলের।বর্ষা মৌসুমে পর্যাপ্ত পানি পাওয়া গেলেও তা ‘পান ও ব্যবহার’ করা নিয়ে পড়তে হয় বিপাকে। তখন বৃষ্টির জল আর পাহাড়ি ঢলে ঘোলা হয়ে যায় ছড়া-ঝরনা-কুয়ার পানি।

জলবায়ু পরিবর্তন, বৃষ্টিপাত কম হওয়া ও পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় পানির সংকট বাড়ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তারা বলছেন, নির্বিচারে বন উজাড়, জনবসতি বৃদ্ধি ও পাহাড় ধসের কারণে পার্বত্য এলাকায় পানির উৎস কমে গেছে।

আয়তনে দেশের সবচেয়ে বড় জেলা রাঙামাটি। তবে সে অনুপাতে জেলাটিতে লোকসংখ্যা তুলনামূলক কম। অনেকটাই বিক্ষিপ্তভাবে বসবাস করেন পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর মানুষ।

রাঙামাটির সবচেয়ে বড় ইউনিয়ন সাজেক। ৬০৭ বর্গমাইল সাজেক ইউনিয়নের গ্রামের সংখ্যা ১৫১টি। লোকসংখ্যা ২৫ হাজার ৬৭ জন। শুকনো মৌসুমে এ ইউনিয়নের ৮০ শতাংশই পানির সংকটে ভোগেন।

সাজেক ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নেলশন চাকমা বলেন, ‘চাহিদার তুলনায় পানির সরবরাহ একেবারেই অপ্রতুল। পাহাড়ি নারীরা ছড়া, ঝরনা কিংবা কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করেন। এ জন্য প্রতিদিনই ৩-৪ কিলোমিটার খাড়াই পথ হাঁটতে হয় তাদের।’

রাঙামাটিতে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে পানির সংকট। বিশেষ করে দুর্গম পাহাড়ি জনপদগুলোর মানুষেরাই পড়ছেন পানির ভোগান্তিতে। সংকট এতটাই প্রকট যে সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোও সুরাহা করতে সক্ষম হচ্ছে না। জেলার ৫০ শতাংশ মানুষই পানির সংকটে ভুগছেন। আর পৌর এলাকায় ৭০ শতাংশ মানুষ এ সংকটে ভুগছেন।

পানি সরবরাহের জন্য উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে রাঙামাটি জেলা পরিষদ, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) ও জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর (ডিপিএইচই)।

ডিপিএইচইর দাবি, জেলার ১০ উপজেলার ৫০ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পানির সুবিধায় আনা গেছে। যা আগামী পাঁচ বছরে উন্নীত হবে ৭৫ শতাংশে। আর পৌর এলাকার মাত্র ৩০ শতাংশ জনগোষ্ঠী এসেছে পানি সুবিধার আওতায়। যা শতভাগ হতে ২০৪৫ সালকে টার্গেটে নেওয়া হয়েছে।

জেলার ১০ উপজেলার মধ্যে কাউখালী, বাঘাইছড়ি, বরকল, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি, জুরাছড়ি ও রাজস্থলীতে পানির সংকট বেশি।

কাউখালীর দুর্গম ফটিকছড়ি ইউনিয়নের ২৭ গ্রামে সাড়ে সাত হাজার মানুষের বাস। অথচ প্রয়োজনীয় সংখ্যক নলকূপ নেই সেখানে।

ফটিকছড়ির চেয়ারম্যান উষাতন চাকমা বলেন, ‘মানুষকে ছড়া বা কুয়া থেকে পানি সংগ্রহ করতে হচ্ছে। এ পানিই পান এবং ব্যবহার করা হচ্ছে। এতে নানা পানিবাহিত রোগেও ভুগতে হচ্ছে গ্রামবাসীকে। আমরা বিভিন্ন মহলে সংকট সমাধানে তদবির করছি।’

বরকল আইমাছড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সুবিমল চাকমা বলেন, ‘বরকল পাহাড় এলাকায় পানির সংকট প্রকট। নলকূপ স্থাপন করা দুরূহ। নদীর পানিও পানের উপযোগী নয়। মানুষকে ছড়া বা কুয়ার পানির ওপরই নির্ভর করতে হচ্ছে। পানি ফুটিয়ে পান করতে অভ্যস্ত নন পাহাড়ের মানুষ। তাই পানিবাহিত রোগেও ভুগতে হয় তাদের।’

রাঙামাটি জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী অনুপম দে বলেন, ‘পাহাড়ে অনেক প্রতিকূলতা আছে। দুর্গম এলাকায় পৌঁছানো যায় না। তাই কাজ করা সম্ভব হয় না। নতুন প্রকল্প পাস হলে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে জেলার ৭৫ শতাংশ জনগোষ্ঠীকে পানি সুবিধার আওতায় আনা যাবে।’

মন্তব্য

Beta version