-->
শিরোনাম

শেরপুর সীমান্তে এখনো নিশ্চিত হয়নি ‘সুপেয় পানি’

শাকিল মুরাদ, শেরপুর
শেরপুর সীমান্তে এখনো নিশ্চিত হয়নি ‘সুপেয় পানি’
ভ্যানে করে পানি নিয়ে আসছেন ঝিনাইগাতীর সীমান্তবর্তীরা

শেরপুর সীমান্ত অঞ্চলের ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ার কারণে দুটি ইউনিয়নে ১২টি গ্রামে দেখা দিয়েছে খাবার পানির তীব্র সংকট। বিশুদ্ধ খাবার পানি না পেয়ে ঝর্ণা, পুকুর ও কুয়ার পানি পান করছেন এসব এলাকার মানুষ। প্রতিবছর বোরো মৌসুমে অন্তত ৪-৫ মাস পানির অভাবে থাকতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। যদিও সংকট সমাধানের জন্য আশ^াস দিয়েছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।

জানা যায়, ঝিনাইগাতী উপজেলার পানবর, গুরুচরণ দুধনই, গজনী গান্ধীগাঁও, বৃষ্ণপুর গ্রাম ও শ্রীবরদী উপজেলার বালিজুড়ি, খারামোড়া, হালুয়াহাটিসহ দুই উপজেলার মোট ১২টি গ্রামে প্রচুর পাথর থাকায় ও ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় সাধারণ নলকূপ দিয়ে পানি আসে না। পানি তোলার জন্য একমাত্র বিদ্যুৎচালিত গভীর সাবমারসিবল পাম্প বসিয়ে পানি উত্তোলন করা সম্ভব, যা করতে এক থেকে তিন লাখ টাকা খরচ করতে হয়।

কিন্তু এখানকার সাধারণ মানুষের পক্ষে তা বহন করা সম্ভব নয়। তাই প্রতি প্রতিবছর বোরো মৌসুম এলেই এমন সমস্যা সৃষ্টি হয়। ফলে চার থেকে পাঁচ মাস পর্যন্ত কষ্ট করতে হয় এখানকার বাসিন্দাদের। আবার ওই এলাকায় যারা সচ্চল মানুষ আছেন তারা ব্যক্তিমালিকানায় বিদ্যুৎচালিত গভীর সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছেন। ওইসব বাড়ি থেকে পানি নেওয়ার জন্য আশপাশের লোকজন জগ, বালতি, কলস, বোতল নিয়ে ভিড় করেন।

পুকুর থেকে পানি তোলা হচ্ছে

শ্রীবরদীর বালিজুড়ির হালুয়াহাটি এলাকায় সরেজমিনে গিয়ে যায়, কোনো টিউবওয়েলে পানি নেই। টিউবওয়েল চাপ দিলে পানি আসে না। মাঝে মাঝে এক-দু ফোঁটা পানি বের হচ্ছে। এজন্য খাওয়া, রান্না ও প্রতিদিনের কাজের জন্য পুকুর থেকে পানি নিয়ে আসছেন মানুষ। সেই পানি দিয়ে থালা-বাসনসহ নানা কাজে ব্যবহার করছেন তারা। শুধু তা-ই নয়, ঝর্ণা ও কুয়ার পানি খাচ্ছে এখানকার শিশুরা। ফলে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে।

স্থানীয়রা জানান, এসব এলাকা পাহাড়ি অঞ্চল হওয়ায় বোরো মৌসুমে ভূ-গর্ভস্থ পানির স্তর নিচে নেমে যায়। তাই বাধ্য হয়েই ময়লাযুক্ত পানি খেতে হয় তাদের। ময়লা পানি খাওয়ার কারণে শিশু ও বয়স্করা পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। তাই পানি সংকটের গ্রামগুলোর আশপাশে কয়েকটি সাবমারসিবল পাম্প থাকলে হয়তো পানির সংকট সমাধান হবে।

রাণীশিমুল ইউনিয়নের বাসিন্দা রমজান আলী বলেন, ‘আমি ধান ক্ষেতে পানি দিতে একটি বিদ্যুৎচালিত সাবমারসিবল পাম্প বসিয়েছি। বোরো মৌসুমে এই এলাকায় কোনো টিউবওয়েলে পানি ওঠে না। তখন আমার পাম্প থেকেই এ এলাকার মানুষ পানি নিয়ে যায়। মেশিন চালু করলে সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ে। এতে তাদেরও অনেক কষ্ট হয়, আমারও অসুবিধা হয়।’

হালুয়াহাটি গ্রামের বাসিন্দা সোহেল মিয়া বলেন, ‘আমগর এইদিকে পানি থাকে না এই বোরো মৌসুমে। এই মৌসুমে পানি নিচে চলে যায়গা। প্রতিবছরই এমন সমস্যা হলেও সরকার এইদিকে নজর দেই না।’

‘আমরা যে পানির জন্য কত কষ্ট করি, কত ময়লা পানি খাইতেছি। আর এইসব ময়লা পানি খাওয়ার কারণে বিশেষ করে শিশুরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাই সরকারের কাছে জোর দাবি জানাই, যেন দ্রুত সময়ের মধ্যে আমাদের এই দিকে সাবমারসিবল পাম্প বসায়’, বলেন সোহেল মিয়া।

ওই এলাকার বাসিন্দা লাল মিয়া বলেন, ‘ভাই আমরা তো গরিব মানুষ। দিন আনি দিন খাই, এত ট্যাহা নাই যে সাবমারসিবল পাম্প বসামু। কত যে কষ্ট করি পানির জন্য। আমগর বাড়ির একটু দূরে একজন পাম্প বসাইছে, সেখান থেকে বালতি ভরে ভ্যান গাড়ি দিয়ে পানি আনি।’

কুয়া থেকে পানি তোলা হচ্ছে

 

ঝিনাইগাতীর বৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা ফকির মিয়া বলেন, ‘ভাই আপনেরা প্রতিবছরই আহেন, কল তো দেন না, খালি ছবি তুলে নিয়ে যান গা। এবার ছবি তুললে আগে কল দেন, তারপর ছবি তুলবেন। হুনি সরকার কত কিছুই দিতাছে কিন্তু আমাগরে খালি কলই দেই না। কয়ডা কল হলে এখানে পানির আর কষ্ট থাকবে না।’

ওই গ্রামের বাসিন্দা রোজিনা আক্তার বলেন, ‘অনেকদিন ধরে আমরা রান্না ও খাওয়ার জন্য অন্য বাড়ি থেকে পানি টেনে টেনে নিয়ে আসি। খুব কষ্ট হয় পানি আনতে।’

ঝিনাইগাতীর পানবর এলাকার নয় বছরের শিশু লামিয়া বলেন, ‘আঙগর কলে পানি আহে না, আমি পুকুরে গোসল করি। আর আম্মা পানি আগুন দিয়ে ফুঁটায়া দে, ওই পানি খাই। অনেক সময় দেহা যা আম্মা ব্যস্ত থাহে ওই টাইমে ঘরে যে পানি থাহে অইডাই খাই।’

শ্রীবরদীর খারামোড়া গ্রামের ছয় বছরের শিশু জান্নাত আরা বলে, ‘পানি বারাই না কল থনে, আম্মা মেলা দূর থনে পানি নিয়ে আহে। আম্মার মেলা কষ্ট হয়, তাই আঙগর উনু এডা কল দেন।’

শ্রীবরদী উপজেলা চেয়ারম্যান এডিএম শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘শ্রীবরদীর সীমান্তে কয়েকটি গ্রামের পানির সংকট আছে। গত বছর কয়েকটি সাবমারসিবল পাম্প বসানো হয়েছে, এই মৌসুমেও পাম্প বসানো হবে সেজন্য কাজ করা হচ্ছে। শিগগিরই পানির সংকট সমাধান হবে আশা করি।’

ঝিনাইগাতী উপজেলা চেয়ারম্যান এসএম আব্দুল্লাহেল ওয়ারেজ নাইম বলেন, ‘ঝিনাইগাতীর বেশ কয়েকটি গ্রামে শুষ্ক মৌসুমে নলকূপে পানি ওঠে না। আমরা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু কিছু জায়গায় সাবমারসিবল পাম্প বসাচ্ছি। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে চাহিদা পাঠিয়েছি। আশা করছি, খুব শিগগিরই এ সমস্যার সমাধান হবে।’

এ ব্যাপারে শেরপুর জেলা জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী ছামিউল হক দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘সীমান্তে পাহাড়ি এলাকায় পানির সংকট নিরসনে আমাদের পক্ষ থেকে সব ধরনের চেষ্টা করা হচ্ছে। সাধারণ মানুষ যাতে বিশুদ্ধ পানি খেতে পারে এজন্য ইতোমধ্যে কয়েকটা গভীর পাম্প বসানো হয়েছে।

‘যেসব এলাকায় পানির সমস্যা বেশি, সেসব এলাকায় বরাদ্দ পাওয়া সাপেক্ষে গভীর নলকূপ ও সাবমারসিবল পাম্প বসানো হবে। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে আরো বরাদ্দ চেয়েছি, বরাদ্দ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পর্যায়ক্রমে সব গ্রামেই পাম্প বসানো হবে। এতে ওইসব এলাকার পানির সংকট দূর হবে।’

মন্তব্য

Beta version