-->
শিরোনাম

আঁচলেই ভরসা!

শাকিল মুরাদ, শেরপুর
আঁচলেই ভরসা!
শেরপুর সদরের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের হাজিপাড়ায় আঁচল কেন্দ্র

শেরপুরের প্রতিটি গ্রামে রয়েছে ডোবা, নালা, খাল-বিল। প্রায়শ এসব স্থানে শিশুদের পানিতে ডুবে মৃত্যুর খবর পাওয়া যেত। কিন্তু জেলা সদরের নিরাপদ শিশুকেন্দ্র (আঁচল কেন্দ্র) প্রতিষ্ঠা হওয়ার পর থেকেই মৃত্যুর হার কমেছে অনেকটা।

শিশুদের নিরাপদে রাখতে কাজ করছে বাংলাদেশ সেন্টার ফল ইনজুরি প্রিভেনশন অ্যান্ড রিসার্চ (সিআইপিআরবি) নামে একটি সংগঠন। তাদের সহযোগিতায় গড়ে উঠেছে আঁচল কেন্দ্র। এসব কেন্দ্রের মাধ্যমে শিশুরা নিরাপদে থাকে। শুধু নিরাপদে থাকা নয়, এসব কেন্দ্রে শিশুদের প্রাথমিকের শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে।

সিআইপিআরবি শেরপুর কার্যালয়ের তথ্যমতে, শেরপুর সদরের সাতটি ইউনিয়নে ৫৩২টি আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। প্রতিটি আঁচল কেন্দ্রে ২০-২৫ জন শিশু রয়েছে। এসব ইউনিয়নে আঁচলের কার্যক্রম শুরু হওয়ার পর থেকেই পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমেছে প্রায় ৫০ শতাংশের বেশি।

সরেজমিনে সদর উপজেলার রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের হাজিপাড়ায় আঁচল কেন্দ্রে গিয়ে দেখা যায়, ছোট ছোট শিশুদের ছন্দে ছন্দে শেখানো হচ্ছে ছড়া, কবিতাসহ অংক। শিশুরাও আনন্দের সঙ্গে মনোযোগ দিয়ে তা শিখছে।আরেক পাশে দেখা গেছে, কয়েকটি শিশু একসঙ্গে একত্র হয়ে খেলা করছে। তাদের দেখাশোনা করছেন আঁচল মা।

এই কেন্দ্রের আঁচল মা নিপা বেগম। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আঁচলে শুধু শিশুদের বসিয়ে রাখা হয় না, প্রাক-প্রাথমিকের নানা শিক্ষাও দেওয়া হয়। প্রতি সপ্তাহে ছয় দিন সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত নয় মাস থেকে তিন বছর বয়সি শিশুদের আঁচলে রাখার ব্যবস্থা রয়েছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘৪-৫ বছরের শিশুরাও আঁচলে আসে। আগে প্রতিবছর এই গ্রামে অনেক শিশু পানিতে ডুবে বা অন্যান্য কারণে মারা যেত। কিন্তু আঁচল কেন্দ্র হওয়ার পর থেকেই এটা কমে গেছে।’

শোলারচর গ্রামের বাসিন্দা মানিক-লেবুজা দম্পতির মেয়ে ছামিয়া আক্তার (৩)। ছোট্ট ছামিয়াকে আঁচল কেন্দ্রে নিয়মিত রাখেন তার বাবা-মা। কথা হয় লেবুজা খাতুনের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আঁচলডা হওয়ার পর কত যে আরামে আছি, বাচ্চারে নিয়ে কোনো সমস্যা হয় না। সকালে ঘুম থেকে উঠে টুকটাক কাজ সেরে বাচ্চাকে আঁচলে দিয়ে আসি। দুপুরে গোসল করে ও খাওয়া শেষ করে তাকে নিয়ে আসি। এতে আমার কাজের কোনো সমস্যা হয় না। বাচ্চাকে নিয়েও চিন্তা হয় না।’

একই গ্রামের বাসিন্দা ইয়াছমিন বেগম বলেন, ‘আমার চার বছরের মাইয়া মিম এই আঁচলে থাকে। আমি সকাল থেকে সব কাজকাম শেষ করে মেয়েকে আনতে যাই। এই কেন্দ্র থাকার কারণে খুব ভালো হইছে।’

হাজিপাড়ার বাসিন্দা হেলাল মিয়া বলেন, ‘করোনার জন্য মেলা দিন থেকে এই স্কুুল (আঁচল কেন্দ্র) বন্ধ। তাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিশুদের ক্লাস নেয় তারা। আমরা সরকারের কাছে দাবি জানাই যেন স্কুলটা খুইলি দেয়।’

শোলারচর গ্রামের বাসিন্দা ফারজানা। গত বছর তার মেয়ে বাড়ির পাশের ডোবায় পড়ে মারা যায়। তিনি বলেন, ‘গত বছরের ১৮ সেপ্টেম্বরে আমার বাচ্চাকে ভাশুরের মেয়ের কাছে রেখে বাইরে গিয়েছিলাম। কাজ শেষ করে এসে তাদের খুঁজে পাচ্ছিলাম না। অনেক খোঁজাখুঁজির পর বাড়ির পাশে একটি ডোবাতে দুজনের লাশ দেখতে পাই।’

‘এই চিত্র দেখেই আমি অজ্ঞান হয়ে পড়ি। যাই হোক, এরপর দেখলাম আমাদের বাড়ির পাশে আঁচল নামে একটা কেন্দ্র আসছে, সেখানে বাচ্চাদের রেখে যাওয়ার সুবিধা আছে’, যোগ করেন সন্তান হারানো এই মা।

শিশুদের ছড়া, কবিতা ও অংক শেখাচ্ছেন আঁচল মা। ছবিটি শেরপুর সদরের রঘুনাথপুর শোলারচর গ্রামের হাজিপাড়ায় আঁচল কেন্দ্র থেকে তোলা

 

সদর উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়ন পরিষদের ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার মো. আব্দুল করিম বলেন, ‘গ্রামে এই আঁচল কেন্দ্র থাকায় মানুষের অনেক উপকার হয়েছে। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত প্রায় প্রতিটি মা-বাবা বা পরিবারের অন্য সদস্যরা ব্যস্ত থাকে। তাই শিশুদের দেখাশোনা করার কেউ থাকে না। কিন্তু আঁচল কেন্দ্র থাকায় শিশুকে খুব সহজে সেই কেন্দ্রে রেখে সব কাজ করতে পারে কোনো ঝামেলা ছাড়াই।’

তিনি আরো বলেন, ‘আঁচল কেন্দ্র হওয়ার পর থেকেই এই গ্রামে পানিতে ডুবে বা অন্যান্য কারণে তেমন কোনো মৃত্যু নেই। আমি ধন্যবাদ জানাই আঁচল কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের।’

সম্প্রতি শেরপুরে একটি প্রশিক্ষণে এসেছিলেন বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা সমষ্টির গবেষণা ও যোগাযোগ পরিচালক মো. রেজাউল হক। এ সময় তিনি বলেন, আমাদের গবেষণায় দেখা গেছে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এ সময়ে শিশুর মা-বাবা গৃহস্থালির কাজে ব্যস্ত থাকেন। যার কারণে এই সময়টা শিশুদের জন্য বিপজ্জনক সময়। দেশের যেসব জেলা-উপজেলা বা ইউনিয়নে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার বেশি রয়েছে, সেসব এলাকায় আঁচল কেন্দ্র বাধ্যতামূলক প্রতিষ্ঠা করা হয়।’

সদর উপজেলা সিআইপিআরবি কার্যালয়ের সমন্বয়ক মো. আব্দুল্লাহ আল কাফি বলেন, ‘আঁচল কেন্দ্রের কারণে সদরে পানিতে ডুবে মৃত্যু অনেকটাই কমে গেছে। পাশাপাশি আঁচল কেন্দ্রের আশপাশে শিশুদের পরিবার অনেক সচেতন হয়েছে। আঁচল কেন্দ্রে একদিকে যেমন শিশুরা নিরাপদে থাকছে, অন্যদিকে শিশুরা প্রাথমিক শিক্ষাও পাচ্ছে।’

শেরপুর জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘উদ্যোগটা খুবই ভালো। আমি কিছুদিন আগে একটা প্রশিক্ষণের প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলাম, তখন অনেক কিছুই শুনেছি এবং জেনেছি। আমাদের প্রশাসন থেকে সার্বিকভাবে তাদের প্রতি সহযোগিতা থাকবে, যাতে জেলায় পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার কমে।’

শেরপুর ছাড়াও নরসিংদী, চাঁদপুর, কুমিল্লা, সিরাজগঞ্জ, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলায় সিআইপিআরবির দিবাযত্ন বা আঁচল কেন্দ্র রয়েছে। এসব জেলার ১০ উপজেলায় ৩ হাজার ২০০টি আঁচল কেন্দ্রে প্রায় ৮০ হাজার শিশু রয়েছে।

মন্তব্য

Beta version