ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর চাপ এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাওয়ায় বরিশাল নগরীতে বিশুদ্ধ খাবার পানির তীব্র সংকট দেখা দিয়েছে। নগরীতে বসবাসরত বাসিন্দাদের প্রতিদিন পানির চাহিদার বিপরীতে ঘাটতি রয়েছে ৪৫ শতাংশ। খাবার পানির সংকট নিরসনে শতকোটি টাকা ব্যয়ে নগরীতে দুটি পানি শোধনাগার প্লান্ট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নির্মাণ ত্রুটির কারণে ৫ বছরেও তা চালু করতে পারেনি সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ।
বরিশাল সিটি করপোরেশনের পানি বিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সিটির ৩০ ওয়ার্ডের বাসিন্দাদের দৈনিক পানির চাহিদা রয়েছে প্রায় পাঁচ কোটি ২৬ লাখ লিটার। সেখানে পানি সরবরাহ হচ্ছে দুই কোটি ৪০ লাখ লিটার। ঘাটতি দুই কোটি ৮৬ লাখ লিটার; যা মোট চাহিদার ৪৫ শতাংশ। সুপেয় পানির ঘাটতি পূরণে নগরের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি পর্যায়ে প্রায় পাঁচ হাজার গভীর নলকূপ রয়েছে। এসবের প্রত্যেকটিতে সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে পানি তোলা হয়।
তবে বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) বরিশাল বিভাগীয় কমিটির এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নগরীতে ব্যক্তি পর্যায়ে গভীর নলকূপ রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার। এসব নলকূপের প্রত্যেকটির সঙ্গেই উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন সাবমারসিবল পাম্প দিয়ে প্রতিদিন ভূগর্ভস্থ থেকে লাখ লাখ লিটার পানি তোলা হচ্ছে। এতে করে ভূগর্ভস্থ পানির উৎসের ওপর চাপ এবং পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে।
বরিশাল জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর সূত্রে জানা যায়, পানি সরবরাহ প্রকল্পের আওতায় ২০১৩ সালে নগরীর বেলতলা ও রুপাতলি এলাকায় ৪৩ কোটি টাকা ব্যয়ে দুটি পানি শোধনাগারের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ২০১৫ সালের জুনে শোধনাগার দুটির নির্মাণকাজ শেষ হয়। নানা জটিলতার পর ২০১৮ সালে শোধনাগার দুটি আনুষ্ঠানিকভাবে বরিশাল সিটি করপোরেশনের কাছে হস্তান্তর করা হয়।
তবে দুই দপ্তরের দ্বন্দ্বে ৫ বছরেও চালু করা সম্ভব হয়নি শোধনাগার দুটি। দীর্ঘদিন ব্যবহার না হওয়ায় এর যন্ত্রাংশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অপরিকল্পিতভাবে নির্মাণ করায় একটি শোধনাগারের বেশিরভাগ বিলীন হয়ে গেছে নদীতে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, সিটির সদর রোড, প্যারারা রোড, আগরপুর রোড, নিউ সার্কুলার রোড, চাঁদমারী, নাজিরমহল্লা, কাউনিয়া, আমানতগঞ্জ, ভাটিখানা, পলাশপুর নথুল্লাবাদ, জিয়া সড়কসহ অনেক স্থানে পানির স্তর নেমে গেছে। চাপকল তো দূরের কথা টিউবওয়েলের পানি ওঠাতে সাবমারসিবল মোটর দীর্ঘসময় ছেড়ে রাখতে হচ্ছে।
আগরপুর রোডের বাসিন্দা আবু জাফর ইকবাল বলেন, ‘মাঝরাতে সাবমারসিবল মোটর ছেড়ে রাখি। তখন পানি পাওয়া যায়। এ কারণে দুটি মোটর নষ্ট হয়ে গেছে। ভাবছিলাম পর্যাপ্ত সাপ্লায়ের পানি পাবো তাও পাচ্ছি না। দিন দিন পানির কষ্ট বাড়ছে।’
জিয়া সড়কের বাসিন্দা নার্গিস আক্তার কাজল বলেন, ‘তাদের এলাকায় পানি সরবরাহ কম। কোনো মতে হিসাব করে পানি ব্যবহার করতে হয়। মাঝে মাঝে বোতলজাত পানি কিনে খেতে হয়।’
স্থানীয় পরিবেশ বিষয়ক গবেষক রফিকুল আলম বলেন, ‘অতিমাত্রায় পানি উত্তোলনের ফলে ভূগর্ভস্থ উৎসগুলোর বেশি চাপ পড়ছে। এতে করে উৎসগুলোতে ঝুঁকি বাড়ছে। পাশাপাশি উপরিস্তরের উৎসগুলোও বিপন্ন হচ্ছে।’
তিরি আরো বলেন, ‘সিটি এলাকায় প্রবাহমান ২২-২৩টি খাল দখল-দূষণে ভরে গেছে। পুকুরগুলো যে যার মতো ভরাট করে ফেলছে। ফলে নগরে উপরিস্তরের পানির উৎস বলতে এখন আর অবশিষ্ট কিছু নেই। নগরে বিশুদ্ধ পানি সংকট নিরসনে দুই প্রান্তে দুটি পানি শোধনাগার প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়। কিন্তু সংশ্লিষ্টদের গাফিলতির কারণে নির্মাণ শেষ হওয়ার ৫ বছরেও চালু হয়নি এগুলো।’
‘এ অবস্থায় আগামী ২-৩ বছরে পানির সংকট আরো ভয়াবহ আকার ধারণ করবে। এই সংকট নিরসনে এখনই দখলে বিপন্ন খালগুলো উদ্ধার করে প্রবাহ সচল, দুটি সারফেস ওয়াটার ট্রিটমেন্ট চালু, বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আধুনিকায়ন, ভূগর্ভস্থ স্তরের ওপর চাপ কমানো দরকার’, যোগ করেন তিনি।
দুটি পানি শোধনাগারের বিষয়ে সিটি করপোরেশনের পানি শাখার সহকারী তত্ত্বাবধায়ক সোহরাব হোসেন বলেন, ‘নগরীতে নির্মিত দুটি পানি শোধনাগার চালু করতে আরো সংস্কার প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ চেয়ে একটি প্রকল্প প্রস্তাব সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। তবে এখন পর্যন্ত কোনো অগ্রগতি নেই।’
মন্তব্য