-->
শিরোনাম
সেচের অভাবে দুই কৃষকের আত্মহত্যা

বরেন্দ্র অঞ্চলের দুঃখ পানি?

তারেক মাহমুদ, রাজশাহী ব্যুরো
বরেন্দ্র অঞ্চলের দুঃখ পানি?
মৃত কৃষকদের স্বজনরা

রাজশাহীর গোদাগাড়ির নিমঘুটু গ্রামের কৃষক অভিনাথ মার্ডি ও তার চাচাতো ভাই রবি মার্ডি। রান্না করে খাওয়ার জন্য তাদের ঘরে ছিল না চাল। এ কারণে টানা কয়েকদিন তাদের ঘরে জ্বলেনি চুলা। তবে দিন এনে দিন খাওয়া সংসারে টিকে থাকার লড়াইয়ে ঘামতি ছিল না একদমই। কারণ তাদের চোখে স্বপ্ন ছিল একদিন এই অভাব থেকে মুক্তি মিলবে।

তাইতো এনজিও থেকে ঋণ নিয়ে বরেন্দ্র লাল মাটিতে বর্গা জমিতে ধান চাষ করেন অভিনাথ ও রবি। অথচ সেচের জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নলকূপ অপারেটরের কাছে দিনের পর দিন ঘুরেও বঞ্চিত হতে হয় এখানকার কৃষকদের।

এ বছর ভাগ্য সহায় ছিল না অভিনাথ ও রবির। দিনের পর দিন ঘুরেও সেচের ব্যবস্থা করতে না পেরে চোখের সামনে শেষ অবলম্বনটুকু বিবর্ণ হতে দেখে আর স্থির থাকতে পারেননি তারা।

গত বুধবার সেই জমিতেই আত্মহননের চেষ্টা করেন অভিনাথ ও রবি। সেদিনই নিজ বাড়িতে মারা যান অভিনাথ। আর তিনদিন মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে শুক্রবার রাতে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান রবি।

অভিযোগ রয়েছে, উপজেলার ঈশ্বরীপুর মাঠে ধানের জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য বরেন্দ্র বহুমুখী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিএমডিএ) ডিপ অপারেটর শাখাওয়াতের কাছে ১২ দিন ধরে ঘুরছিলেন অভিনাথ ও রবি। কিন্তু তাদের সেচের পানি দেওয়া হয়নি।

এদিকে পানির অভাবে ধানি জমি বিবর্ণ হতে থাকে। সবশেষ বুধবার আবারও ডিপ অপারেটরের কাছে সেচের পানির জন্য যান দুই ভাই। কিন্তু সিরিয়াল না পেয়ে তারা এক সঙ্গে বিষ পান করেন।

মূলত এই দুই কৃষকের আত্মহত্যার ঘটনা তুলে এনেছে সরকারি সংস্থার সেচ ব্যবস্থাপনায় স্থানীয় পর্যায়ে বঞ্চনার এমন করুণ চিত্র। প্রমাণ করেছে, কেমন আছে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষকরা।

রাজশাহী গোদাগাড়ি উপজেলার রক্ষাগোলা কমিটি সমাজ সংগঠক রনজিৎ শাওরিয়া বলেন, বরেন্দ্রর জমিতে ফসল ফলাতে ঋণ নেন দরিদ্র ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর মানুষ। অথচ সেচের জন্য বরেন্দ্র উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের নলকূপ অপারেটরের কাছে দিনের পর দিন ঘুরেও বঞ্চিত হতে হয়।

‘পানি শুকিয়ে ধানি জমি বিবর্ণ হওয়া এখানে নিত্যদিনের ঘটনা। সেই সময় কৃষক যখন মাঠ ফেটে চৌচির হতে দেখেন, তখন শঙ্কা জাগে ফসল নষ্ট হয়ে সর্বশান্ত হওয়ার। ওই দুই কৃষকের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে বরেন্দ্রের কৃষকদের করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে’ বলেন রনজিৎ শাওরিয়া।

মৃত অভিনাথ মার্ডির স্ত্রী রোজিনা হেমব্রম জানান, ঋণের টাকায় পরের জমিতে ধান চাষ করেছিলেন তার স্বামী। কিন্তু সেচের অভাবে ধান গাছ নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তার স্বামী বিষপান করে আত্মহত্যা করেছেন।

মৃত রবি মার্ডির মা দুলিনা মুমু বলেন, ‘প্রভাবশালীদের কাছ থেকে অপমান আর বঞ্চিত হয়েই আমার ছেলে বিষপান করেছে। আমি এর বিচার চাই।’

এদিকে এ ঘটনায় থানায় মামলা করেছেন নিহতের স্বজনরা। গত শুক্রবার রাতে দায়ের করা মামলায় গোদাগাড়ী উপজেলার ঈশ্বরীপুর মাঠে ধানের জমিতে সেচ দেওয়ার দায়িত্বরত বিএমডিএর নলকূপ অপারেটর শাখাওয়াতের বিরুদ্ধে আত্মহত্যায় প্ররোচনার অভিযোগ আনা হয়েছে।

গোদাগাড়ি এলাকার কৃষক বাপ্পী মার্ডি বলেন, ‘কয়েক বছর ধরে আমরা বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষাবাদ করে আসছি। এই গরম মৌসুম আসলে আমাদের কষ্টের শেষ থাকে না। জমিতে সেচ দেওয়ার জন্য নলকূপ অপারেটরের কাছে দিনের পর দিন ঘুরি। যারা নলকূপ অপারেটরের কাছের মানুষ তারা সকল সুবিধা পায়। পানিও পায়। শুধু আমাদের ক্ষেত্রে পানি দেওয়ার কোনো সিরিয়াল থাকে না। পানির অভাবে আশানুরূপ ফলন হয় না।’

তানোর উপজেলার কৃষক ইব্রাহিম খলির বলেন, ‘এর আগে নলকূপ অপারেটর আমার জমিতে কয়েক সপ্তাহ পানি দেয়নি। এ কারণে আমিসহ আরো ছয়জন উপজেলা নির্বাহী অফিসার বরাবর লিখিত অভিযোগ করি। আমাদের ২৬ বিঘা জমিতে আলুর আবাদ করা হয়েছিল, কয়েক সপ্তাহ পানি না দেওয়ায় ফসলের অনেক ক্ষতি হয়। নলকূপ অপারেটরের কাছে পানি চাইলে নানা তালবাহানা শুরু করে। মাঝে মাঝে হুমকিও দেয়। এই সমস্যা কয়েক বছর ধরে চলছে। আমরা এই সমস্যার সমাধান চাই।’

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তানোর উপজেলার কয়েকজন জানান, সেচের এই সমস্যা দীর্ঘদিনের। এর মূল কারণ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিরা। তাদের হাতে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ হয়। তাই কেউ প্রতিবাদ করে না। কোনো কৃষক প্রতিবাদ করলে তার জমিতে পানি দেওয়া বন্ধ করে দেওয়া হয়।

সুশাসন বিশ্লেষক সুব্রত পাল জানান, পানি না পাওয়ার কারণে যদি এই আত্মহত্যার ঘটনা ঘটে, তবে তা খুবই দুঃখজনক।

‘এ ঘটনাটি মানুষের মধ্যে হতাশা তৈরি করতে পারে। তাই এ ঘটনার সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হওয়া উচিত। সময় নষ্ট না করে প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণ করা উচিত। তা না হলে বিচারহীনতার সংস্কৃতি বাড়তে পারে’ বলেন সুব্রত পাল।

আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় কমিটির আহ্বায়ক ফজলে হোসেন বাদশা (এমপি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। প্রান্তিক এই মানুষদের বঞ্চনার বিষয়টি নিয়ে সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কথা বলবেন তিনি।

রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম বলেন, ‘সঠিক তদন্ত করে দোষীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা ময়নাতদন্ত রিপোর্টের জন্য অপেক্ষা করছি। রিপোর্ট পেলে বিষয়টি স্পষ্ট হবে।’

রাজশাহী জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ইফতেখায়ের আলম বলেন, ‘মামলার পর থেকেই আসামিরা পালাতক রয়েছে। আমরা আসামিদের ধরতে কাজ করছি।’

মন্তব্য

Beta version