মাটি, পরিবেশ ও স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হলো তামাক চাষাবাদ। এ কারণে সরকারের পক্ষ থেকে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করা হচ্ছে। তবে তামাক প্রক্রিয়াজাত কোম্পানিগুলোর আর্থিক সহযোগিতায় দিন দিন এর চাষ বাড়ছে। বিশেষ করে তামাক চাষে ঝুঁকে পড়ছে নীলফামারীর কৃষকরা।
বিনা মূল্যে বীজ, ঋণের উপর সার ও নগদ অর্থসহ জমিতে অন্য ফসলের চেয়ে তামাকের উৎপাদন বেশি হওয়ায় এবং স্থানীয় বাজারগুলোতে তামাকের আশানুরূপ মূল্য পাওয়ায় এর উৎপাদনে আগ্রহী হয়ে উঠছেন কৃষকরা। দিন যত যাচ্ছে ততই বাড়ছে তামাকের চাষ। এ অবস্থায় চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছেন এলাকার সাধারণ মানুষ ও কৃষকরা।
জেলা স্বাস্থ্য বিভাগ বলছে, তামাক চাষ ও সেবন মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর। তামাক পাতা, বিড়ি, সিগারেট, গুল, খইনি ও জর্দাসহ এ ধরনের নেশাজাতীয় দ্রব্য সেবন করায় বাড়ছে ক্যানসারসহ নানা রোগ।
এছাড়া তামাক কাটার পর রোদে শুকিয়ে আঁটি বেঁধে ঘরে তুলতে হয়। বিক্রি না হওয়া পর্যন্ত নাড়াচাড়া করতে হয়। এরপর তামাক যায় কোম্পানির গোডাউনে। সেখানেও তামাক পাতা সংরক্ষণ করতে হয়। এতে তামাকের গন্ধ সরাসরি মানবদেহে প্রবেশ করে শিশুসহ নানা বয়সি মানুষ রোগে আক্রান্ত হয়।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র মতে, জেলায় গত অর্থবছরে তামাক চাষে জমির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৬৭০ হেক্টর। এ বছর তামাক চাষ হয়েছে দুই হাজার ৫৯৫ হেক্টর জমিতে। সেই হিসাবে এবার ৭৫ হেক্টর জমিতে তামাক চাষ কম হয়েছে। তবে স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, গতবারের চেয়ে এবার তামাকের চাষ বেড়েছে।
জেলা সদর, ডোমার, ডিমলা, কিশোরগঞ্জ, সৈয়দপুর, জলঢাকা উপজেলার বেশ কয়েকটি ইউনিয়ন ঘুরে দেখা গেছে, দৃষ্টি যতদূর যায় শুধু তামাক চাষের মহোৎসব চোখে পড়ে। এছাড়া তামাক কাটার পর রোদে শুকিয়ে আঁটি বেঁধে ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত কৃষকরা।
মূলত ১৯৮৪ সাল থেকে ব্রিটিশ আমেরিকা ট্যোবাকো, জাপান ট্যোবাকো, আকিজ ট্যোবাকো, ঢাকা ট্যোবাকো, আবুল খায়ের ও আলফা ট্যোবাকোসহ বেশ কয়েকটি কোম্পানি দীর্ঘদিন যাবৎ নীলফামারীতে তামাক চাষ ও বিস্তারে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছে। এসব কোম্পানি তামাক পোড়ানোর সরঞ্জাম সরবরাহ এবং দাদন হিসেবে অগ্রিম টাকা দেওয়ার প্রলোভন দেখায় কৃষকদের। তারা তামাক চাষে অগ্রিম টাকাসহ কৃষকদের সার ও বীজ সরবরাহ করে।
এছাড়াও তামাক কোম্পানির কর্মীরা প্রতিদিন মাঠে গিয়ে কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কিন্তু কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে কখনো অন্য ফসল উৎপাদনের জন্য এ ধরনের উদ্যোগ দেখা যায়নি।
কৃষকদের দাবি, বোরো মৌসুমে বীজতলা, সবজি ও ফসলের ক্ষেত নষ্ট হলেও কৃষি অফিসের লোকজনকে সংবাদ দিয়েও দেখা পাওয়া না। ফলে পরিবেশ বিধ্বংসী তামাক চাষে মাঠে নামে কৃষকরা। কৃষি জমিতে তামাক আবাদের ফলে চলতি মৌসুমে বোরোর আবাদ ও রবিশস্য উৎপাদনে ব্যাপক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
নীলফামারী সদরের টুপামারি ইউনিয়নের দলুয়া দোগাছি গ্রামের কৃষক আজিজুল বলেন, ‘এবার তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। ধান আবাদ করে লোকসান গুনতে হয়। তাই বাধ্য হয়ে এবার তিন বিঘা জমিতে তামাক চাষ করেছি। ক্ষতিকর জেনেও লাভের আশায় তামাক চাষ করি।’
একই এলাকার কৃষক খগেন চন্দ্র রায় বলেন, ‘বর্তমানে শ্রমিকের অনেক দাম। যে টাকা খরচ করে অন্য ফসল চাষ করি, বাজারে সঠিক দাম না থাকায় বিক্রি করে সেই টাকা ওঠে না। অল্প খরচে কোম্পানির টাকায় তামাক চাষ করে অধিক লাভ হয়।’
স্বাস্থ্যের ক্ষতির কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘যখন তামাকের কাঁচা পাতাগুলো গাঁথি তখন গন্ধে খারাপ লাগে। কিন্তু কী করব? এখন তো খেয়ে বাঁচি। পরে যা হওয়ার হবে।’
তামাকের ডাটা ও পাতা কাটা চাতালে কাজ করেন স্থানীয় গঙ্গারাম। তিনি বলেন, ‘আমি ১০ বছর ধরে এই চাতালে মেশিনে তামাক পাতা কেটে বিড়ির শুকা বানাই। এতে আমার চোখ ও গলায় বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিয়েছে। রাতে চোখে দেখি না। সর্দি-কাশিতো লেগেই আছে। এই কাজ ছেড়ে অন্য পেশায় চলে যেতে চাই।’
নীলফামারী জেনারেল হাসপাতালের নাক, কান ও গলা বিশেষজ্ঞ ডা. জাহাঙ্গীর আলম বলেন, তামাকজাত দ্রব্য সেবনে নাক, গলা, ঠোঁট ও মুখের ক্যানসার হওয়ার শতভাগ ঝুঁকি থাকে। বিশেষ করে গলার ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। ধূমপানে বিষপান এই কথার কোনো বিকল্প নেই। ধূমপায়ীদের সামাজিকভাবে সচেতন করতে হবে। তাহলে সুফল আসতে পারে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. আবু বক্কর সিদ্দিক জানান, মাঠপর্যায়ে কৃষি কর্মকর্তারা তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে বিভিন্নভাবে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছেন। ফলে এবার ৭৫ হেক্টর জমিতে তামাক উৎপাদন কমেছে। আশা করছি, আগামীতে তামাকের চাষ আরো কমবে।
মন্তব্য