-->

ভয় বাড়ছে লঞ্চ যাত্রীদের

জহির রায়হান, বরিশাল ব্যুরো
ভয় বাড়ছে লঞ্চ যাত্রীদের
বরিশাল লঞ্চ টার্মিনাল

দিনে দিনে বিলাসবহুল লঞ্চের সংখ্যা বাড়লেও তুলনামূলক বাড়েনি তার মান। তাই তো একের পর এক ঘটছে নৌ-দুর্ঘটনা। এতে বাড়ছে হতাহতের সংখ্যা। কোনোভাবেই তা নিয়ন্ত্রণে আসছে না। ফলে নৌপথে ভ্রমণে যাত্রীদের ভয় বাড়ছে। মূলত লঞ্চ কর্তৃপক্ষ অদক্ষ স্টাফ দিয়ে নৌযান পরিচালনা করায় এমন দুর্ঘটনা ঘটছে বলে মনে করছেন স্থানীয় বিশ্লেষকরা।

গত বছরের ২৩ ডিসেম্বর রাতে ঝালকাঠির সুগন্ধা নদীতে এমভি অভিযান-১০ লঞ্চে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে ৪৮ জনের মৃত্যু এবং আরো ২৬ জন নিখোঁজের ঘটনায় লঞ্চ কর্তৃপক্ষ ও সংশ্লিষ্ট প্রশাসন নড়েচড়ে বসলেও এখনো শৃঙ্খলা ফেরানো সম্ভব হয়নি।

ওই দুর্ঘটনার পর চলতি বছরের ৮ জানুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বরিশাল ফেরার পথে সুরভী-৯ লঞ্চের সাইলেন্সার পাইপ থেকে বাষ্পীয় ধোঁয়া বের হওয়ার ঘটনা ঘটে। এতে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়ে।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বরিশালগামী এমভি সুরভী-৭ নামের একটি লঞ্চের সঙ্গে বাল্কহেডের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে বাল্কহেডের একজন মারা যান।

১৮ মার্চ সন্ধ্যা ৭টার দিকে ঝালকাঠি থেকে ঢাকাগামী এমভি ফারহান-৭ নামের একটি লঞ্চের সঙ্গে বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষ হয়। এতে বাল্কহেডটি ডুবে যায়। সুগন্ধা নদীতে এ সংঘর্ষে লঞ্চটির সামনের অংশ ফেটে যায়। অল্পের জন্য রক্ষা পায় লঞ্চটির তিন শতাধিক আরোহী। পরে লঞ্চটি পাশের চরে নোঙর করে যাত্রীদের নামিয়ে দিয়ে যাত্রা বাতিল করা হয়।

২০ মার্চ রোববার দুপুর ২টার দিকে নারায়ণগঞ্জের সদর উপজেলার আল-আমিন নগর এলাকার শীতলক্ষ্যা নদীতে কার্গো জাহাজ এমভি রূপসী-৯ এর ধাক্কায় এমএম আশরাফ উদ্দিন নামে একটি যাত্রীবাহী লঞ্চ ডুবির ঘটনা ঘটে। এ ঘটনায় এখন পর্যন্ত ১১ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। তবে নিখোঁজ রয়েছেন আরো একজন।

সর্বশেষ ২৭ মার্চ বুড়িগঙ্গা নদীর সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালে নোঙর করা অবস্থায় ঢাকা-বরিশালগামী এমভি অ্যাডভেঞ্চার-৯ লঞ্চের ভিআইপি কেবিনে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে। এতে কোনো হতাহতের খবর পাওয়া যায়নি।

গত রোববার বরিশাল থেকে ঢাকাগামী সুরভী-৮ লঞ্চের যাত্রী সুমন বলেন, ‘সড়ক পথের চেয়ে নৌপথে লঞ্চে বেশি যাতায়াত করে দক্ষিণাঞ্চলের যাত্রীরা। তবে লঞ্চের মধ্যে যাত্রীদের সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করার ঘটনা প্রতিদিনের। এছাড়া খুনের মতো ঘটনা ঘটছে। লঞ্চের ত্রুটির কারণে প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। তাই এখন লঞ্চে ভ্রমণ করতে ভয় লাগে।’ঢাকাগামী এমবি মানামী লঞ্চের যাত্রী মোসাম্মৎ মরিয়ম বেগম বলেন, ‘প্রায়ই লঞ্চে আগুন লাগার ঘটনা শুনি। তাই লঞ্চে উঠলেই আতঙ্কে থাকি কখন দুর্ঘটনা ঘটে।’

ঢাকাগামী পারাবাত-১২ লঞ্চের যাত্রী মোহাম্মদ কায়সার বলেন, ‘পরিবার থেকে লঞ্চে উঠতে নিষেধ করে। তারপরও ভয় আর ঝুঁকি নিয়ে লঞ্চে যাতায়াত করছি।’

স্থানীয় গবেষক ও প্রবীণ সাংবাদিক আনিসুর রহমান খান স্বপন বলেন, ‘লঞ্চে একের পর এক দুর্ঘটনা ঘটছে। এতে যাত্রী ও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ উভয়ই ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কিন্তু দুর্ঘটনা প্রতিরোধে যেসব সতর্কতা থাকা দরকার তা পুরোপুরি মানছে না লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। তাই লঞ্চ ভ্রমণে যাত্রীদের ভয় বাড়ছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘লঞ্চ চালক, মাস্টার, সুপারভাইজারসহ সংশ্লিষ্ট স্টাফদের আধুনিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার পাশাপাশি নিয়মিত অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের নজরদারি আরো বাড়ানো উচিত।

এছাড়াও প্রতিদিন লঞ্চ ছাড়ার সময় ফিটনেস পরীক্ষা করা এবং গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার না করার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে। লঞ্চ পরিচালনা স্টাফদের মধ্যে সতর্কতা ও সচেতনতা সৃষ্টি না হলে কোনো মামলা দিয়ে যাত্রীসেবা নিশ্চিত এবং দুর্ঘটনা প্রতিরোধ করা সম্ভব নয় বলে মনে করছেন এই গবেষক।

অভ্যন্তরীণ লঞ্চ মালিক সমিতির সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান রিন্টু বলেন, যাতে কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে সে বিষয়ে লঞ্চ মালিক ও স্টাফরা সব সময়ই সতর্ক থাকে। কিন্তু তারপরও কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে।

বরিশাল অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহণ কর্তৃপক্ষের যুগ্ম পরিচালক ও নৌবন্দর কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘নৌ পথে দুর্ঘটনা প্রতিরোধ, পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা ও যাত্রীসেবা নিশ্চিত করতে নিষ্ঠা-স্বচ্ছতার সঙ্গে কাজ করছে বিআইডব্লিউটিএ। আমরা চাই ঢাকা-বরিশাল রুটটি দুর্ঘটনা মুক্ত, সুন্দর ও সুশৃঙ্খল রুটে পরিণত হোক। পুরোপুরি শৃঙ্খলা ফিরে আসুক।’

মন্তব্য

Beta version