-->
শিরোনাম

ভালো আছেন বিধবাপল্লির বিধবারা

শাকিল মুরাদ, শেরপুর
ভালো আছেন বিধবাপল্লির বিধবারা
‘সৌরজায়া’স্মৃতিসৌধটির সামনে দাঁড়িয়ে আছেন জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদসহ বিধবারা

১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নৃশংস গণহত্যা সংঘটিত হয়েছিল নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে। পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার-আলবদররা এদিন এই গ্রামের সব পুরুষকে (১৮৭ জন) মাত্র দুই ঘণ্টার মধ্যে হত্যা করে। এরপর থেকেই এই গ্রামের নামকরণ হয় বিধবাপল্লি।

স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে দীর্ঘদিন বুকচাপা কষ্ট আর অনটনে দিন কেটেছে এই বিধবাপল্লির বিধবা ও তাদের সন্তানদের। তাদের খোঁজ রাখেনি কেউ। দেয়নি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর সবই যেন পাল্টে যায় দিনকে দিন। বর্তমানে প্রশাসনের সহযোগিতায় খুব ভালো আছেন তারা। সুখে-শান্তিতে জীবন কাটছে তাদের।

মূলত ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার ক্ষমতায় এলে সোহাগপুর বিধবাপল্লিতে সহায়তার হাত বাড়ান মতিয়া চৌধুরী। ধাপে ধাপে তারই প্রচেষ্টায় বিধবাদের প্রত্যেকে সেনাবাহিনীর ট্রাস্ট ব্যাংক থেকে দুই হাজার টাকা, বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক থেকে ৪০০ ও সরকার থেকে ৪০০ টাকা হারে বয়স্ক ভাতাসহ মোট দুই হাজার ৮০০ টাকা পাচ্ছিলেন। এরই মধ্যে ২৯ বিধবাকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১১ লাখ টাকা মূল্যের একটি করে পাকা বাড়ি উপহার দিয়েছেন। ১৪ জন বীরাঙ্গনাকে মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

বিধবাপল্লিতে হয়েছে পাকা সড়ক। কাঁকরকান্দির বুরয়াজানি গ্রামে শহীদদের স্মরণে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা কলেজ, প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয় করে দিয়েছেন মতিয়া চৌধুরী। সেই বিধবাদের মূল্যায়নের পাশাপাশি তাদের পরিবার-পরিজনদের জীবনমান উন্নয়নে কাজ শুরু করে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন। নানা উৎসবে তাদের সঙ্গে থাকেন জেলা প্রশাসক মোমিনুর রশীদ ও পুলিশ সুপার হাসান নাহিদ চৌধুরী।

এ ছাড়া দীর্ঘ ৫০ বছর পর শহীদদের স্মৃতি রক্ষার জন্য জেলা পুলিশ বিভাগের সদস্যরা তাদের বেতনের টাকা দিয়ে জমি ক্রয় করে দিয়েছেন। সম্প্রতি মুক্তিযুদ্ধে নিহতদের স্মরণে জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে ‘সৌরজায়া’ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হয়েছে।

জানা গেছে, ময়মনসিংহের তৎকালীন আলবদর কমান্ডার জামায়াত নেতা কামারুজ্জামানের সহায়তায় ১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই নালিতাবাড়ী উপজেলার কাঁকরকান্দি ইউনিয়নের নিভৃত পল্লি সোহাগপুর গ্রামে ঘটে এক ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডি। সেদিন এ গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় নিয়েছেÑ এমন তথ্যের ভিত্তিতে রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় ১৫০ জনের পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্থানীয় প্রফুল্লের দিঘি থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন্ত এলাকা ঘিরে ফেলে। তারা অর্ধদিন তাণ্ডব চালিয়ে খুঁজতে থাকে মুক্তিযোদ্ধাদের ও তাদের আশ্রয়দাতাদের।

ওই সময় জীবনের মায়া ত্যাগ করে সামনের দিকে এগিয়ে যান স্থানীয় কৃষক আলী হোসেন ও জমির আলী। কিন্তু তারা বেশিদূর যেতে পারেননি। এক রাজাকার গুলি করে দুজনকেই হত্যা করে। এরপর একে একে আরো ১৮৭ জন নিরীহ পুরুষকে হত্যা করা হয়।

একই সঙ্গে হায়েনাদের পাশবিক নির্যাতনের শিকার হন ১৩ জন নারী। সেদিন কলাপাতা, ছেঁড়া শাড়ি আর মশারি দিয়ে কাফন পরিয়ে চার থেকে পাঁচটি করে লাশ এক একটি কবরে দাফন করা হয়েছিল। আবার কোনো কোনো কবরে সাত-আটটি করে লাশও একসঙ্গে কবর দেওয়া হয়েছিল। এরপর থেকেই ওই গ্রামের নামকরণ হয় বিধবাপল্লি।

বিধবাপল্লির বাসিন্দা শহীদ শুকুর মামুদের স্ত্রী ফরিদা বেওয়া বলেন, ‘আমার জামাইডা (স্বামী) মইরি (মারা) যাওয়ার পর কত যে কষ্ট করছি তা বুঝাবার পামু না। আল্লাহর রহমতে এহন (এখন) খুব শান্তিতে আছি। ডিসিসাব, এসপিসাব আহে (আসে) মাঝে মাঝেই আয়ে (এসে)। আঙগর (আমাদের) চাল-ডালসগ মেলাকিছু (অনেক কিছু) দে। আমরা দোয়া করি তাদের জন্য।’

বিধবা হাফিজা বেওয়া বলেন, ‘স্বামী-স্বজনগরে মাইরা হালানির পরে ভিক্ষা কইরাও খাইছি। শেখের বেডি আর মতিয়া চৌধুরী আমগর লাইগা অনেক কিছু করছে। আমরা মুক্তিযোদ্ধার পদবি পাইছি, ভাতা পাইতাছি। আমগরে চাওয়া-পাওয়ার আর কিছু নাই।’শহীদ ইব্রাহিমের স্ত্রী হাবিজা বেগম বলেন, ‘বাবা আল্লাহ অনেক ভালা (ভালো) রাখছে, পেট ভইরি (ভরে) চারইড্ডে খাবার পাই, শান্তিতে ঘুমাবার পাই, মাসে মাসে টেহাও (টাকা) পাই। আঙগর (আমাদের) যে কত সুবিধা হইছে।’

সিরাজ আলীর স্ত্রী শমলা বেওয়া বলেন, ‘আগে কি কষ্টই না করছি, এহন শেখের বেডির কারণে শান্তিতে ঘুমাবার পাইতাছি, ঠিকমতো খাওয়া পাইতেছি, কোনো ভয় নাই, সব সময় নিরাপত্তা পাই, আমরা খুব খুশি।’

বিধবাপল্লির শহীদ পরিবার কল্যাণ সমিতির সভাপতি জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আগে খুব কষ্ট করে দিন চালাইছে বিধবারা। এখন খুব শান্তিতে পাকা ঘরে ঘুমাচ্ছেন তারা। শুধু তাই নয়, তারা প্রতি মাসে ভাতা পাচ্ছে, জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বিভিন্ন সময় সহযোগিতা করে যাচ্ছে। এত কিছু সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে। আল্লাহ উনারে বাঁচিয়ে রাখুক।’

নালিতাবাড়ী থানার অফিসার ইনচার্জ বছির আহম্মেদ বাদল বলেন, ‘পুলিশ সুপার হাসান নাহিদ চৌধুরী স্যারের নির্দেশনা মোতাবেক সোহাগপুর বিধবাপল্লিতে আমরা প্রতিনিয়ত খোঁজখবর রাখছি, তাদের কি সমস্যা শুনছি, আবার সমস্যার সমাধানও করে দিচ্ছি। এই পল্লির বাসিন্দারা খুব শান্তিতে আছে। আমরা পুলিশ সব সময় তাদের পাশে আছি, থাকব।’

জেলা প্রশাসক মো. মোমিনুর রশীদ বলেন, ‘ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সামনে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তুলে ধরে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করতে এবং শহীদদের সম্মানে শেরপুর জেলা প্রশাসন কাজ করে যাচ্ছে। তাই শুধু সোহাগপুর বিধবাপল্লি নয়, পর্যায়ক্রমে সব শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ করা হবে। একই সঙ্গে সবসময় আমরা শহীদ মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের পাশে আছি।’

মন্তব্য

Beta version