-->

মামুনুলের রিসোর্টকাণ্ডের এক বছর: শেষ হয়নি ১৬ মামলার তদন্ত

সীমান্ত প্রধান, নারায়ণগঞ্জ
মামুনুলের রিসোর্টকাণ্ডের এক বছর:  শেষ হয়নি ১৬ মামলার তদন্ত
মামুনুল হক: ফাইল ছবি

নারায়ণগঞ্জের সোনারগাঁয়ে মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ডের পর দায়ের করা ১৬টি নাশকতা মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্টরা এখনও শেষ করতে পারেনি। তবে মামুনুল হকের বিরুদ্ধে তার কথিত স্ত্রীর দায়ের করা ধর্ষণ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে। চলছে স্বাক্ষ্যগ্রহণ।

এই মামলায় ৪১ জনের মধ্যে এ পর্যন্ত ৮ জনের স্বাক্ষ্যগ্রহণ করেছেন আদালত। আগামী ৯ মে পরবর্তী স্বাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রয়েছে। এদিন নতুন করে আরও চার জন আদালতে সাক্ষী দিবেন বলে আদালত সূত্রে জানা গেছে।

এদিকে মামুনুলের রিসোর্ট কাণ্ডের এক বছর অতিবাহিত হয়েছে গেল ৩ এপ্রিল। গত বছরের এদিন বিকেলের দিকে সোনারগাঁয়ের রয়্যাল রিসোর্টের ৫০১ নম্বর কক্ষে স্থানীয়রা মামুনুল হককে একজন নারীসহ অবরুদ্ধ করে রাখেন। সন্ধ্যা ৭টায় এই খবর পেয়ে স্থানীয় হেফাজতে ইসলামের নেতাকর্মীরা রয়্যাল রিসোর্টে ব্যাপক তাণ্ডব চালিয়ে নারীসহ মামুনুল হককে ছিনিয়ে নিয়ে যায়।

এ ঘটনায় গাড়ি ভাঙচুর, মহাসড়কে আগুন দিয়ে বিক্ষোভ, আওয়ামী লীগ অফিস, যুবলীগ, ছাত্রলীগ নেতার বাড়িঘরে হামলা চালিয়ে ভাঙচুর করে ধর্মভিত্তিক এই দলটির নেতাকর্মীরা। এছাড়াও স্থানীয় এক সাংবাদিককে বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে ফেসবুক লাইভে এসে নির্যাতনের মুখে মামুনুল হকের কাছে ক্ষমা চাইতে বাধ্য করার ঘটনাও ঘটে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রয়্যাল রিসোর্টে তাণ্ডবের পর সোনারগাঁও থানায় আটটি, সিদ্ধিরগঞ্জ সাতটি এবং রূপগঞ্জে একটিসহ মোট ১৬টি মামলা করা হয়। এসব মামলার মধ্যে তিনটিতেই মামুনুল হককে মূল আসামি করা হয়েছে। এছাড়াও বিএনপি, জাতীয় পার্টি, জামায়াত, হেফাজতের আরও কয়েকশ নেতাকর্মীর নাম উল্লেখসহ অন্তত ১৫০০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়। তবে, দায়েরকৃত এই ১৬টি মামলার তদন্তকাজ এখনো শেষ করতে পারেনি পুলিশ। চার্জশিট দাখিল না করায় শুরু হয়নি বিচার কাজও।

এদিকে সোনারগাঁও থানায় গত বছরের ৩০ এপ্রিল মামুনুলের কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা মামুনুলের বিরুদ্ধে ধর্ষণের অভিযোগ এনে আরও একটি মামলা করেন। ওই মামলার তদন্ত কর্মকর্তা শফিকুল ইসলাম গেল বছরের ১০ সেপ্টেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন। ৩ নভেম্বর মামুনুলের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন (চার্জ) করে বিচার শুরু করে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালত। ২৪ নভেম্বর আদালতে জবানবন্দি দেন ঝর্ণা। তিনি আদালতকে জানিয়েছেন, বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে রয়্যাল রিসোর্ট ছাড়াও আরো বিভিন্ন স্থানে নিয়ে তাকে ধর্ষণ করেছে মামুনুল।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, মামুনুলের বিরুদ্ধে দায়ের করা ধর্ষণ মামলার বিচার কাজ শুরু হয়েছে। এ মামলায় ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে এখন পর্যন্ত আটজন সাক্ষ্য দিয়েছেন। তারা হলেন রয়্যাল রিসোর্টের সুপারভাইজার আব্দুল আজিজ, রিসিপশন অফিসার নাজমুল ইসলাম অনিক ও নিরাপত্তা প্রহরি রতন বড়াল। এছাড়া চলতি বছরের ২৫ জানুয়ারি সাক্ষ্য দিয়েছেন উপজেলা যুবলীগের সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু, রয়্যাল রিসোর্টের এক্সিকিউটিভ মাহাবুবুর রহমান ও নিরাপত্তা প্রহরি ইসমাইল হোসেন।নারী ও শিশু নির্যাতন ট্রাইব্যুনালের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী রকিবুদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, ধর্ষণ মামলায় মামুনুলের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আগামী ৯ মে পরবর্তী সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য রেখেছেন আদালত।

আদালত সূত্রে জানা গেছে, নাশকতার মামলায় গেল বছরের ১৮ এপ্রিল মোহাম্মদপুরের জামিয়া রাহমানিয়া আরাবিয়া মাদরাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তার বিরুদ্ধে সোনারগাঁও থানায় করা ধর্ষণ ও সহিংসতার তিনটি এবং সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় করা নাশকতার তিনটিসহ ছয়টি মামলায় ১৮ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন আদালত। পরে গত বছরের ৩০ এপ্রিল বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে দুই বছর ধরে ধর্ষণের অভিযোগে হেফাজত নেতা মামুনুল হকের বিরুদ্ধে সোনারগাঁ থানায় মামলা করেন কথিত দ্বিতীয় স্ত্রী জান্নাত আরা ঝর্ণা।

এদিকে মামুনুল হকের রিসোর্ট কাণ্ডে ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখিন হয়েছিল রয়্যাল রিসোর্ট। অন্তত কোটি টাকার ক্ষতিরমুখে পড়ে রিসোর্টটির কর্তৃপক্ষ। সেই ঘটনার একবছর অতিবাহিত হলেও ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারেননি তারা। রিসোর্টের ব্যবস্থাপক খাইরুল কবির লাল বলেন, ‘এক কোটি টাকার বেশি ব্যয় হয়েছে মেরামত কাজে। এর পুরোটাই তো লোকসান।’

খাইরুল কবির আরো বলেন, ‘করোনার কারণে এই সময়ে ব্যবসায় এমনিতেই মন্দা। তার ওপর এত টাকার ধকল। সব মিলিয়ে ভালো থাকার তো সুযোগ নেই।’ তবে ওই ঘটনায় রিসোর্ট কর্তৃপক্ষ কোনো মামলা দায়ের করেননি বলে জানান এই কর্মকর্তা। তবে স্থানীয় আওয়ামী লীগের কার্যালয় ভাঙচুর ও উপজেলা যুবলীগ রফিকুল ইসলাম নান্নু তার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে হামলা-ভাঙচুরের ঘটনায় মামলা করেন।

খাইরুল কবির বলেন, ‘আমাদের এই রিসোর্টে দেশিয় গেস্টের চেয়ে বিদেশি গেস্ট বেশি আসে। আর আসে কাপল। তবে মামুনুল হক কাণ্ডের পর আগের মতো আর কাপল আসে না। মাঝেমধ্যে কিছু গেস্ট আসে। ওই ঘটনায় শুধু রিসোর্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, ব্যবসারও লোকসান হয়েছে। কর্তৃপক্ষ চেষ্টা করছে, আগের অবস্থানে ফিরে যেতে।’উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি সামসুল ইসলাম ভূঁইয়া বলেন, ‘আমাদের আওয়ামী লীগ অফিসে ভাঙচুর করে অনেক ক্ষয়ক্ষতি করা হয়। পরে আমরা নিজ উদ্যোগে সেগুলো মেরামত করেছি।’

যুবলীগের সোনারগাঁ উপজেলার সভাপতি রফিকুল ইসলাম নান্নু বলেন, ‘মামুনুলের ঘটনায় হেফাজত নেতা-কর্মীদের হামলা, ভাঙচুরে আমার প্রায় দুই কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে, যা আর পূরণ হয়নি।’সোনারগাঁ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ওসি হাফিজুর রহমান জানান, এসব ঘটনায় মোট সাতটি মামলা হয়েছে। সব কটি মামলা তদন্তাধীন।

সিদ্ধিরগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) মশিউর রহমান জানান, সিদ্ধিরগঞ্জ থানায় দায়েরকৃত ৭টি মামলার মধ্যে ৩টি থানা পুলিশ তদন্ত করছে। বাকি ৪টি মামলা সিআইডি, পিবিআই ও ডিবি পুলিশ তদন্ত করছে। আমার জানা মতে এসব মামলার কোনটিরই তদন্ত শেষ হয়নি। সবগুলো মামলার তদন্তকাজ চলমান রয়েছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) পুলিশ পরিদর্শক সাইফুল ইসলাম জানান, যতদিন পর্যন্ত মামলা শেষ না হবে, ততদিন পর্যন্ত এ বিষয়ে কিছু বলা যাবে না। তবে তদন্ত চলছে।

নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি (পিপি) মনিরুজ্জামান বুলবুল জানান, মামুনুল হকের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত ধর্ষণ মামলার বিচার শুরু হলেও হরতাল ও রিসোর্টকাণ্ডে নাশকতার মামলাগুলোর কোনটিরই এখনো পর্যন্ত আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হয়নি। যে কারণে ওইসব মামলার বিচারকাজ শুরু হয়নি।

অন্যদিকে আসামি পক্ষের আইনজীবী ওমর ফারুক নয়ন জানিয়েছেন, তার মক্কেলের বিরুদ্ধে দায়ের করা ধর্ষণ মামলাটি ষড়যন্ত্রের একটি অংশ। তার মক্কেল ষড়যন্ত্রের শিকার। এই মামলায় আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ চলছে। আগামী ৯ মে সাক্ষ্যগ্রহণের দিন ধার্য আছে। এদিন চারজনের সাক্ষ্যগ্রহণ করবেন আদালত।এদিকে ধর্ষণ মামলায় মামুনুল হককে যতবার আদালতে আনা হয়েছে, ততবার তিনি কোনো না কোনো ঘটনা ঘটিয়েছেন। পুলিশের ওপর ক্ষিপ্ত হওয়া, মামলার বাদিকে হুমকি ধামকি দেওয়া। এমনকি তার অনুসারীরাও আদালত চত্বরে হট্টগোল করেছেন বেশ কয়েকবার। ফলে প্রথম দিকে মামুনুলকে অন্যান্য আসামির মতো আদালতে হাজির করা হলেও তার এসব কর্মকাণ্ডে পুলিশের নিরাপত্তা বাড়ানো হয়েছে বলে জানান আদালত পুলিশের পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) আসাদুজ্জামান।তিনি বলেন, ‘মামুনুল হককে যখন শুনানিতে আনা হয়, সে তারিখে আদালতের প্রবেশ ফটকে নিরাপত্তা জোরদার করা হয়। পাশাপাশি বহিরাগতের প্রবেশের সময় জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়ে থাকে। কারণ বিগত সময় নানা ঘটনা ঘটেছে।’

মন্তব্য

Beta version