-->

পেঁয়াজের বাম্পার ফলনেও হাসি নেই কৃষকের

পার্থ হাসান, পাবনা
পেঁয়াজের বাম্পার ফলনেও হাসি নেই কৃষকের
ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ তুলে পাশেই জমা করা হচ্ছে

পাবনার সুজানগর, সাঁথিয়া ও বেড়ায় এবার পেঁয়াজের বাম্পার ফলন হয়েছে। জেলার বাজারগুলো এখন পেঁয়াজে সয়লাব। কিন্তু তাতে হাসি নেই পেঁয়াজচাষিদের মুখে। ফলনে সন্তুষ্ট হলেও দাম নিয়ে বিপাকে পড়েছেন তারা। লাভ তো দূরের কথা- বীজ, জমির মূল্য, সার-কীটনাশক ও শ্রমিকের মজুরি মিলে চাষিদের উৎপাদন খরচই উঠছে না।

পাবনার হাজিরহাট, পুষ্পপাড়াহাট, বনগ্রাম হাট, আতাইকুলা বাজার, সুজানগরহাট, সাঁথিয়া বাজার, ধুলাউড়ি হাট, বেড়ার চতুরহাট, দুবলিয়ার হাটসহ বিভিন্ন হাটবাজার ঘুরে দেখা গেছে, ভ্যান, করিমন, অটোরিকশা, ট্রলি, মিনি ট্রাকসহ বিভিন্ন পরিবহণে পেঁয়াজ নিয়ে বাজারে আসছেন চাষিরা। কিন্তু তেমন ক্রেতা না থাকায় হতাশ হয়ে বসে আছেন তারা। দরদামে জোরাজুরি না করে পাইকারি ব্যাপারীরা দাম বলা মাত্রই পেঁয়াজ বিক্রি করে বাড়ি ফিরছেন চাষিরা।

এ বছর জেলায় ৪৪ হাজার ৪৫ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজ আবাদের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে ৪৪ হাজার ৮১০ হেক্টর জমিতে তাহেরপুরী, ফরিদপুরী, বারি পেঁয়াজ-১, কলসনগর, লালতীর কিং, হাইঃ লালতীর, হাইঃ ইস্পাহানী ও হাই মেটাল জাতের পেঁয়াজ আবাদ হয়েছে। আর গত বছর আবাদ হয়েছিল ৪৪ হাজার ৩০ হেক্টর জমিতে। এবার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৬ লাখ ৩৫ হাজার ৫১৩ মেট্রিক টন।

এর মধ্যে সুজানগর উপজেলায় আবাদের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ হাজার ৫শ হেক্টর, আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৩৫০ হেক্টর। এ ছাড়াও সাঁথিয়ায় ১৫ হাজার ৭শ এবং বেড়া উপজেলায় ৩ হাজার ৩৩০ হেক্টর জমিতে পেঁয়াজের আবাদ হয়েছে।

সুজানগরের খয়রান, দুর্গাপুর ও সাঁথিয়ার বনগ্রাম ঘুরে দেখা যায়, তীব্র গরম উপেক্ষা করে ক্ষেত থেকে পেঁয়াজ তুলছেন শ্রমিকরা। চাষিদের পরিবারের অন্য সদস্যরাও পেঁয়াজ মৌসুমে বসে নেই। নারী-শিশুরা ভোর থেকেই ব্যস্ত হয়ে পড়েন শ্রমিকদের খাবার রান্না করা ও পেঁয়াজের মাথা কাটার কাজে। পরিবারের ছোট সন্তানটিও যেন বসে নেই, বাবার কাজের সঙ্গে সেও যেন একজন পেশাদার চাষি। নারীরা গভীর রাত পর্যন্ত পেঁয়াজের মাথা কাটতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন।

সুজানগরের দুর্গাপুরের চাঁদ আলী মণ্ডল বলেন, ‘এবার আমি ২৫ বিঘা জমিতে পেঁয়াজের আবাদ করেছিলাম। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ফলন বেশ ভালো হয়েছে। কিন্তু বাজারে যে দাম দেখছি তাতে উৎপাদন খরচ নিয়ে বাড়ি ফিরতে পারব না। এভাবে বাজারদর অব্যাহত থাকলে আগামীতে পেঁয়াজের চাষ করব কিনা ভাবছি।’

বনগ্রাম হাটে কথা হয় কৃষিতে জাতীয় পুরস্কারপ্রাপ্ত সুজানগরের ভায়না গ্রামের মোহাম্মদ কামরুজ্জামান প্রামাণিকের সঙ্গে। এবার তিনি ২০ বিঘা জমিতে পেঁয়াজ আবাদ করেছেন।

দামে আশাহত হয়ে তিনি বলেন, ‘এক বিঘা জমিতে কীটনাশক খরচ ৩ হাজার টাকা, সার ও চাষ বাবদ ৫ হাজার টাকা। লেবার খরচ ১৫ হাজার টাকা। আর ২০ হাজার টাকা দিয়ে জমি লিজ নিতে হয়। সব মিলিয়ে বিঘাপ্রতি ৪০ হাজার টাকার ওপরে খরচ হয়েছে। এবার বিঘাপ্রতি উৎপাদন হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ মণ, আর বাজারে প্রতি মণ পেঁয়াজ ৬শ থেকে সাড়ে ৮শ টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। এতে প্রতি বিঘায় ৩০ হাজার থেকে ৪০ হাজার টাকার পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে।’

বেড়ার চতুরহাটে পাইকারি ক্রেতা করিম উদ্দিন বলেন, ‘এখন বাজাওে প্রচুর পেঁয়াজ, কিন্তু চাহিদা কম। চাহিদা কম থাকায় দাম কম থাকবে এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এতে চাষিরা যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, তেমনি আমরা পাইকারি ব্যবসায়ীরাও ক্ষতির মুখে আছি। যেহেতু এটাই আমাদের পেশা, তাই লাভ হোক আর লোকসান হোক ব্যবসা তো করতেই হবে।’

পাবনার হাজিরহাটের চাষি শহিদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা চাষিরা একেবারে শেষ হয়ে গিয়েছি। সরকার বাজারদর নিয়ন্ত্রণ করে দাম না বাড়ালে আগামীতে মানুষ পেঁয়াজ চাষে আগ্রহ হারাতে পারে। পেঁয়াজ সংরক্ষণের ব্যবস্থা না থাকায় উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে পেঁয়াজ বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু পরে দেখা যায় দাম বৃদ্ধি পেঁয়েছে, তাতে কৃষকরা আরো হতাশ হচ্ছেন।’

পাবনা জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. মিজানুর রহমান জানান, কৃষি অফিসের সহযোগিতায় এবার পেঁয়াজের ফলন ভালো হয়েছে। বাজারে চাহিদা কম থাকায় দাম একটু কম। তবে পেঁয়াজগুলো যদি সংরক্ষণ করে কিছুদিন পরে বিক্রি করে, তা হলে চাষিরা আরো ভালো দাম পেত।

তিনি বলেন, ‘কৃষকরা যাতে পেঁয়াজের সঠিক দাম পান এ জন্য সরকারি পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরির জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে প্রস্তাবনা দিয়েছি। আশা করছিÑ খুব শিগগিরই পাবনায় একটি বড় আকারের পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার তৈরি করা সম্ভব হবে।’

মন্তব্য

Beta version