-->
বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার

পাঁচ অর্থবছরে ৬২১ কোটি টাকা গচ্চা!

রাজন ভট্টাচার্য
পাঁচ অর্থবছরে ৬২১ কোটি টাকা গচ্চা!
নির্মিত বাঁধ সংস্কারের চেষ্টা হাওরবাসির

হাওরের ফসল রক্ষায় সুনামগঞ্জে গত পাঁচ অর্থবছরে বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতকাজে সরকারের ব্যয় হয়েছে প্রায় ৬২১ কোটি টাকা। এ সময়ে কাগজে-কলমে নতুন নির্মাণ ও সংস্কার করা হয়েছে ৩ হাজার ২৬৯ কিলোমিটার বাঁধ।

প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ অর্থ এ খাতে ব্যয় করা হলেও ফসল রক্ষায় কোনো কাজে আসছে না। জলে যাচ্ছে সরকারের বিপুল পরিমাণ টাকা।

অথচ শুষ্ক মৌসুমে একই বাঁধ সংস্কারে বার বার বরাদ্দ অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। স্থায়ী বাঁধ নির্মাণে নেওয়া হচ্ছে না কার্যকর কোনো ব্যবস্থা। ফলে ২০১৭ সালের পর এবারো অকাল বন্যায় একের পর এক ডুবছে হাওরের ফসল।

পানির সামান্য চাপ সামলাতে পারছে না যেনতেনভাবে সংস্কার করা দুর্বল বাঁধগুলো। চোখের সামনে ডুবছে কৃষকের সোনালি ধান। গোটা হাওরপাড়ে এখন কান্না আর চাপা ক্ষোভ। রাত জেগে বাঁধ পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয় মানুষ। যতটুকু ফসল আছে, তা-ও শেষ পর্যন্ত টিকবে কিনা এ নিয়ে দেখা দিয়েছে সংশয়।

স্থানীয় বাসিন্দা ও হাওর নিয়ে কাজ করছেÑ এমন সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, প্রতি বছর নতুন নতুন বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অর্থ বরাদ্দ হলেও কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না।

বরাদ্দকৃত অর্থ নয়-ছয় বেশি হয়। রাজনৈতিক বিবেচনায় যেমন কাজ দেওয়া হয়, তেমনি কাজে অনিয়ম দুর্নীতি হলেও কাউকে জবাবদিহির আওতায় আনা হচ্ছে না। গত ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবারে সব বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারের কথা থাকলেও ৯২ শতাংশ বাঁধের কাজ মাত্র আংশিক হয়েছিল।

গত ২ মার্চ থেকে পাহাড়ি ঢলের কারণে সীমান্তে নদনদীর পানি বাড়তে থাকে। এ পানি প্রবাহিত হয় ভাটির হাওরের নদনদীতে।

প্রবল পানির চাপে হাওরের নিচু জমিগুলো তলিয়ে যায় প্রথম ধাক্কায়ই; যাতে ক্ষতিগ্রস্ত হয় পাউবোর বাঁধের বাইরের এলাকা। অথচ হাওরের বাঁধ নিয়ে অনিয়ম, সময়মতো কাজ না হওয়ার অভিযোগ শুরু থেকেই করে আসছিলেন কৃষক।

এ পর্যন্ত জেলায় মোট ৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। জেলায় ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

ফলে সাধারণ মানুষের ক্ষোভ বাড়ছে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি), পানি উন্নয়ন বোর্ডসহ সরকারি অন্য কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে।

ইতোমধ্যে দোষীদের বিচারের দাবিতে সুনামগঞ্জ জেলায় বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন সমাধারণ মানুষ।

জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, সুনামগঞ্জ জেলার ১২ উপজেলার ৪২টি হাওরে এ বছর ৭২৭টি পিআইসি ১৩৫টি ক্লোজারসহ ৫৩২ কিলোমিটার বাঁধ মেরামত ও সংস্কারের জন্য সরকার এ বছর ১২১ কোটি টাকার বরাদ্দ দেওয়া হয়।

কিন্ত নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শুরু করা হয়নি। এমনকি বেশিরভাগ বাঁধ বালু মাটি দিয়ে নির্মিত হয়েছে, যার ফলে পাহাড়ি ঢল ও উজানের পানি নেমে চারটি উপজেলার প্রায় ১০টি হাওরের বোরো ফসল পানিতে তলিয়ে গেছে।

তবে সময়মতো অর্থ ছাড় করা হয় না; এমনকি মনিটরিংও ঠিক মতো না হওয়ার অভিযোগ কৃষকের। ২০২০-২১ অর্থবছরে সুনামগঞ্জের ১১ উপজেলায় ৫২টি হাওরে এবার ২ লাখ ২৩ হাজার ৩০০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষাবাদ হয়েছে।

সেই জমির ফসল রক্ষায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের আওতাধীন ৬১৯ কিলোমিটার মাটির বাঁধ নির্মাণ ও মেরামতে ১৩৩ কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়ন হয়েছে।

পাউবো সূত্রে জানা গেছে, গত ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে জেলায় ৬৩৩ কিলোমিটার বাঁধ ও ১৩৯টি ক্লোজার নির্মাণ করা হয়। এজন্য ৭৪৫টি পিআইসি গঠন করা হয়েছিল।

প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ১৩৫ কোটি টাকা। তবে কাজ সম্পন্নের পর চ‚ড়ান্ত বিল দেওয়া হয় ১০২ কোটি টাকা। তবে গত মৌসুমের বাঁধের নির্মাণকাজের টাকা গত ডিসেম্বরে দেওয়া হয়।

এজন্য কৃষক সুনামগঞ্জে দফায় দফায় নানা কর্মসূচিও পালন করেন। ২০১৮-১৯ সালে ৪৫১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণে গঠন করা হয়েছিল ৫৭২টি পিআইসি। এতে প্রাক্কলিত ব্যয় ধরা হয়েছিল ৮০ কোটি ২৪ লাখ টাকা।

জানা গেছে, জেলার মোট ১৩৭টি হাওরে চাষ হয়েছে। এখানে কৃষির সঙ্গে ৩ লাখ ৭৮ হাজার ৭০৫টি পরিবার জড়িত। এখন জেলার ছোট-বড় ১৩৭টি হাওরই ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) জেলা নির্বাহী প্রকৌশলী মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, বৈশাখীর বাঁধ পাউবোর প্রকল্পভুক্ত। এখানের হাওরের অংশটা অনেক গহিন। কালনী নদীর পানি হঠাৎ বেড়ে গিয়ে প্রবল তোড়ে বাঁধটি ভেঙে ফসল ডুবে গেছে।

অন্য যতগুলো হাওর আছে, সেখানকার বাঁধ পাহাড়ি ঢলে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এখন ঝুঁকিতে আছে। দেশের খাদ্যশস্যের একটি বড় জোগান আসে হাওর থেকে। বিশাল হাওর বিস্তৃত ৭ জেলা নিয়ে। এ জমির পুরোটাই এক ফসলি। হাওরের বোরো ধান রক্ষায় রয়েছে ফসল রক্ষা বাঁধ।

এ বাঁধ তলিয়ে গেলে মানুষের দুর্দশার সীমা-পরিসীমা থাকে না। তাই বাঁধ নিয়ে শঙ্কা বোরো ফসল না তোলা পর্যন্ত কাটে না কৃষকের।

সুনামগঞ্জ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক বিপ্লব চন্দ্র সোম বলেন, ‘এ মৌসুমের সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে চাপতির হাওরে। এ হাওরে সাড়ে ৩ হাজার হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে।

এ পর্যন্ত জেলায় মোট ৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে।’ একে একে হাওর পানিতে ডুবে যাওযায় বুধবার সুনামগঞ্জ শহরে বিক্ষোভ হয়েছে। হাওর বাঁচাও আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিজন সেন রায় বলেন, ‘আমরা শুরু থেকেই বলে আসছি পিআইসি গঠনের অনিয়ম করা হয়েছে।

এ কারণেই হাওরের বাঁধের করুণ অবস্থা। আমরা বলেছিলাম স্বচ্ছতা রেখে কাজ করার জন্য। কিন্তু তারা সেটি করেননি।

সুনামগঞ্জ জেলায় ১২১ কোটি টাকার বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। এ টাকাগুলো গেল কোথায়? আজ কেন প্রশাসন স্থানীয় মানুষকে বাঁধে এগিয়ে আসতে বলে। সরকার এত টাকা দেওয়ার পরও আজ কৃষক কেন যাবেন বাঁধ রক্ষা করতে?

সুনামগঞ্জে ফসলডুবির প্রতিবাদে বুধবার দুপুরে হাওর বাঁচাও আন্দোলন জেলা কমিটির ডাকা বিক্ষোভ মিছিল-পরবর্তী সমাবেশ এসব কথা বলেন তিনি। অপরিকল্পিত বাঁধ নির্মাণ, অনিয়ম, ব্যাপক দুর্নীতির কারণে হাওরের ফসলডুবির ঘটনা ঘটেছে বলে অভিযোগ করে বিজন সেন আরো বলেন, এবারের যে লুটপাট হয়েছে, তা ২০১৭ সালকেও ছাড়িয়ে গেছে।

সরকারের টাকা সরকারকে ফিরিয়ে দেওয়া হোক। পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার জরিপে সুনামগঞ্জের হাওরে ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে ধীরগতির পাশাপাশি ৫৮ শতাংশ ক্ষেত্রে প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি (পিআইসি) গঠনে অনিয়ম হয়েছে বলে উঠে এসেছে পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার জরিপে।

শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. মিজানুর রহমান এবং পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার সভাপতি কাসমির রেজার পরিচালনায় পরিবেশ ও হাওর উন্নয়ন সংস্থার হাওরে বাঁধ নির্মাণ নিয়ে জরিপ করে।

কাসমির রেজা জানান, সুনামগঞ্জ জেলার বিভিন্ন উপজেলার ৭২২টি বাঁধের মধ্যে দৈবচয়ন পদ্ধতিতে ১০৮টি বাঁধের ওপর তারা এ জরিপ পরিচালনা করেন। অকাল বন্যায় এবার হাওর ডুবির ঘটনায় সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ছুটে যান পানিসম্পদ উপমন্ত্রী এ কে এম এনামুল হক শামীম।

গত ৭ এপ্রিল সেখানে তিনি বলেন, হাওরে বাঁধের কাজে অনিয়ম হলে কোনো ছাড় নেই। অনিয়ম ও সঠিক সময়ে কাজ না করায় গত তিন বছরে ২২ জন প্রথম শ্রেণির পানি উন্নয়ন বোর্ডের ঠিকাদারকে কালো তালিকাভুক্ত করেছি।

তিনি বলেন, হাওরে প্রকল্প প্রণয়নের ক্ষেত্রে ও প্রকল্প শেষ করার ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিই আমরা। এ বিষয়ে আমাদের শক্তিশালী একটি টাস্কফোর্সের কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। তারপরও এখানে যেহেতু একটি দুর্ঘটনা ঘটেছে, রোববার মন্ত্রণালয়ে গিয়ে একটি সর্বোচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি করে দেব।

তারা এখানে সুষ্ঠু তদন্ত করবে। সেখানে দোষী যেই পর্যায়ের কর্মকর্তাই হোক, তাকে শাস্তির আওতায় আনা হবে। ধর্মপাশায় ভেঙে যাওয়া ডুবাইলের বাঁধ পরিদর্শন শেষে উপমন্ত্রী আরো বলেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ১ তারিখ থেকে ৬ তারিখ পর্যন্ত ১ হাজার ২০৯ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে।

এ কারণেই এ দুর্ঘটনা ঘটছে। বর্ষা এলেই হাওরাঞ্চল, উপক‚লীয় অঞ্চলের মানুষ আতঙ্কে থাকে।

এনামুল হক শামীম বলেন, আমরা সুনামগঞ্জ জেলাকে স্থানীয়ভাবে কীভাবে কাজ করা যায়, সে চিন্তা করছি। স্থায়ী প্রকল্পের পরিকল্পনা করতে প্রধানমন্ত্রী আমাদের নির্দেশনা দিয়েছেন। দুটি প্রকল্প পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে জমা রয়েছে।

পর্যায়ক্রমে পুরো হাওর এলাকাকে আমরা স্থায়ী প্রকল্পের আওতায় নিয়ে আসব। তাহলে স্থায়ীভাবে প্রতি বছর এখানকার কৃষক হাসিমুখে ফসল ঘরে তুলতে পারবেন। কৃষক-শ্রমিকের মুখে হাসি ফুটানোর জন্য প্রধানমন্ত্রী কাজ করছেন।

ক্ষতিগ্রস্ত সবাইকে সহযোগিতা করা হবে। সে অনুযায়ী কাজ চলছে। গতকাল শুক্রবার মন্ত্রী সুনামগঞ্জ সদরে গেলে স্থানীয় কৃষক তার কাছে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কারে অনিয়ম দুর্নীতির বিস্তর অভিযোগ তুলে ধরেন।

মন্তব্য

Beta version