বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের ‘ছোট নদী’ কবিতাটি পড়েননি এমন লোক পাওয়া দুষ্কর। যারা পড়েছেন তারা নিশ্চয়ই মনে রেখেছেন ‘সকালে বিকালে কভু নাওয়া হলে পরে, আঁচলে ছাঁকিয়া তারা ছোট মাছ ধরে’ লাইনটি। বর্তমানে এই লাইনটির বাস্তব চিত্রের দেখা মিলছে উত্তরের জেলা দিনাজপুরে। তবে ছোট মাছের জায়গায় রয়েছে ঝিনুক।
জেলার কাহারোল উপজেলার পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পুনর্ভবা নদী। এই নদীতে গিয়ে দেখা মিলল এমন চিত্রের। নদীর আশপাশ এলাকার মানুষ এই নদীতে দল বেঁধে আসেন গোসল করতে। আর কোনো প্রকার যন্ত্র ছাড়াই সংগ্রহ করেন ঝিনুক।
তারা বলছেন, চোখের জ্যোতি বাড়াতে এসব ঝিনুককে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করেন। আবার কেউ বিক্রি করে সুযোগ করেন বাড়তি আয়ের। গবেষকরা বলছেন, শুধু চোখের জ্যোতিই নয়, ব্লাড প্রেশার কমাতেও সহায়ক ভূমিকা পালন করে ঝিনুক। সম্ভাবনা রয়েছে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনেও। আর মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা বলছেন, ঝিনুক অতিমাত্রায় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করা সুযোগ নেই। অতিমাত্রায় খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে দেখা দিতে পারে পরিবেশগত সংকট।
কাহারোল উপজেলার পুনর্ভবা নদীর কোলঘেঁষা একটি গ্রাম ঈশানপুর। রামচন্দ্রপুর ইউনিয়নে অবস্থানকারী ঈশানপুর গ্রামের বাসিন্দা ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর লদীকি টুডু। চার ঘণ্টার ব্যবধানে সংগ্রহ করেছেন প্রায় কেজি চারেক ঝিনুক। কথা হয় তার সঙ্গে।
তিনি বলেন, ‘এই নদীতে প্রতিবছরই ঝিনুক মারি (সংগ্রহ)। এবারো আসছি, এখান থেকে যা পাই বাড়ি নিয়ে গিয়ে সিদ্ধ করি। তার পর খোলস খুলে, ভিতরে মাংসের মতো পাই, সেটা রান্না করে খাই। আমরা বিক্রি করি না। এসব খাইলে চোখের জ্যোতি ঠিক থাকে।’
একই ইউনিয়নের পরমেশ^রপুর এলাকার কৃষ্ণা রানী রায়। তিনি বলেন, প্রতিবছরই ঝিনুক সংগ্রহ করি। এই ঝিনুক কেউ বাড়িতে নিয়ে গিয়ে হাঁস-মুরগিকে খাওয়ায়। কেউ কেউ আবার নিজেরাও খায়। যেমন আমরা খাই।
‘এই ঝিনুক আবার অনেকে বিক্রি করে। এক কেজি বিক্রি হয় ৭০ থেকে ৮০ টাকায়। আমরা জানি এতে পুষ্টি হয়। চোখের জ্যোতি বাড়ে। আর খেতেও ভালো লাগে। একদম খাসির মাংসের মতো স্বাদ’, বলেন কৃষ্ণা রানী।
নয়াবাদ এলাকার সিলু দাস নামে এক জেলে নদীতে ঝিনুক সংগ্রহ করে তা আবার বাজারে বিক্রি করেন। ১ কেজি ঝিনুকের মূল্য তার কাছে ৬০ থেকে ৭০ টাকা। তিনি চার থেকে পাঁচ ঘণ্টার ব্যবধানে প্রায় ২০ কেজি ঝিনুক সংগ্রহ করেছেন।
তিনি বলেন, ‘এখন নদীতে ঝিনুক পাওয়া যায়। কয়েকদিন বাদে যখন ফের বৃষ্টি হবে নদীতে জল বাড়বে তখন আর ঝিনুক পাওয়া যাবে না। ৪-৫ ঘণ্টা নদীতে থাকলে প্রায় আধা মণ (২০ কেজি) ঝিনুক পাওয়া যায়।
‘শুধু আমি না, আমার মতো প্রায় ১৫ হতে ২০ জন জেলে এই ঝিনুক মারে। ৬০ থেকে ৭০ টাকায় বিক্রি হয় এই ঝিনুক। এগুলো মারছি বিক্রি করার জন্য। যখন কাজকাম থাকে না তখন এইগুলো মারি।’
দিনাজপুর হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের ফুড প্রসেসিং অ্যান্ড প্রিজারভেশন অনুষদের চেয়ারম্যান প্রফেসর ড. মারুফ আহম্মেদ বলেন, বর্তমান সময়ে বাংলাদেশে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী যারা শামুক-ঝিনুক খাচ্ছেন। তারা তাদেও প্রোটিনের ঘাটতি পূরণের জন্য খাচ্ছেন। সত্যিকার অর্থে তাদেও প্রোটিনের ঘাটতি পূরণ হচ্ছে। কারণ শামুক অথবা ঝিনুক প্রোটিনের একটি ভালো সোর্স (উৎস)।
‘এই শামুক-ঝিনুক প্রোটিনের পাশাপাশি মিনারেলের একটি ভালো সোর্স। শামুক-ঝিনুকের মধ্যে বিশেষ করে ক্যালসিয়াম, জিঙ্ক এবং আয়রন প্রচুর পরিমাণে রয়েছে। শামুক-ঝিনুকে কলস্টেরলের পরিমাণ খুবই কম। এটি হাই ব্লাড প্রেশার, অ্যাজমাকে কমাতে পারে। শামুক-ঝিনুক কেবল বাংলাদেশের মানুষই নয়Ñ জাপান, কোরিয়া, চায়না ইত্যাদি দেশেও খায়। এটি স্যুপ আকারে, শুকিয়ে খাওয়া যায়। দেশে শামুক-ঝিনুক চাষ করলে বৈদিশেকি মুদ্রা অর্জনেরও সম্ভাবনা রয়েছে’, বলেন ড. মারুফ আহম্মেদ।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মোক্তাদির খান বলেন, ঝিনুক দুই খোলসবিশিষ্ট একটি জলজ প্রাণী। ঝিনুককে অনেকেই খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকেন। বিদেশে এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে আমাদের দেশে অতিমাত্রা ঝিনুক খাদ্য হিসেবে গ্রহণ এবং আরোহণ করলে পরিবেশগত সংকট দেখা দিতে পারে। তাই ঝিনুক অতিমাত্রায় খাদ্য হিসেবে গ্রহণের সুযোগ নেই।
তিনি বলেন, আমাদের ঝিনুক সংরক্ষণে দায়িত্বশীল হতে হবে। ঝিনুক থেকে মুক্তা চাষের একটি সম্ভাবনা রয়েছে। আমাদের খুঁজতে হবে ঝিনুক থেকে আর্থিকভাবে লাভবান হওয়ার উপায়।
‘মৎস্য অধিদপ্তর চলতি বছরে এ বিষয়ে কার্যক্রম শুরু করেছে। আমরা চাষিদের সঙ্গে কথা বলছি। তাদের এই ঝিনুক চাষের সুফল সম্পর্কে জানানোর চেষ্টা করছি। মুক্তার ব্যবহার সকলে জানলে, মুক্তার বাজার তৈরি হলে সবাই ঝিনুক চাষে আগ্রহী হবেন’, যোগ করেন তিনি।
মন্তব্য