-->
শিরোনাম

টমটমের গ্রাম খোলাশ

রিপন দাস, বগুড়া
টমটমের গ্রাম খোলাশ
বৈশাখ উপলক্ষে বগুড়ায় খেলনা টমটম গাড়ি বানাতে ব্যস্ত সময় পার করছেন এক কারিগর

ছোট শিশুরা মেলায় আসলে পছন্দের খেলনা টমটম কিনে দিতে হবে। আর যারা বড় হয়ে গেছে তাদেরও মনে পরে ছোটবেলার সেই খেলনা গাড়ি টমটমের কথা।

গ্রামীণ মেলার প্রধান আকর্ষণ শিশুদের খেলনা টমটম মনে করিয়ে দেয় বাঙালির ঐতিহ্য আর সংস্কৃতিকে। বিশেষ করে বাংলা নববর্ষে শহর ও গ্রামের পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মেলা শুরু হলে দেখা মিলে এই খেলনার। তবে বগুড়ার ব্যবসায়ী ও কারিগরদের দাবি, দেশের মধ্যে শুধু বগুড়া জেলাতেই টমটম খেলনা তৈরি করা হয়।

জানা গেছে, বগুড়া জেলার দুপচাঁচিয়া উপজেলার সদর ইউনিয়নে অবস্থিত খোলাশ গ্রাম। উপজেলা সদর থেকে এক কিলোমিটার দূরে এই গ্রামের অবস্থান। বছরে বেশিরভাগ সময় দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেলা হওয়ায় এখানে ব্যবসায়ী গড়ে উঠেছে প্রায় শতাধিক। আর একশ’র বেশি পরিবারে কারিগর রয়েছে গড়ে পাঁচ শতাধিক।

দেড়শ’ বছরের বেশি সময় ধরে চলা এ ব্যবসা আজও টিকিয়ে রেখেছে এ গ্রামের সবাই। বংশ পরম্পরায় বয়োবৃদ্ধ ও যুবকের পাশাপাশি কাজ করে ছোটরাও। আর এ খেলনা তৈরির মূল কাজই করে থাকেন পরিবারের নারীরা।

খোলাশ গ্রামে গিয়ে দেখা গেছে, বাঁশ, মাটির খুড়ি আর কাগজের প্রলেপ দিয়ে হাতেই বানানো হচ্ছে টমটম। বাড়ির উঠানে পুরুষরা বাঁশের কাঠি তৈরি করছেন আর নারীরা মাটির খুড়িতে কাগজের প্রলেপের সঙ্গে রং দিয়ে আঁকছেন নকশা। ছোট্ট এ খেলনা বানাতে একজন কারিগরকে গড়ে ২০ বারের বেশি হাত বদল করতে হয়। গভীর মনোযোগ আর দক্ষতার সঙ্গে শুধু হাত ব্যবহার করেই বানানো হয় হাজার হাজার খেলনা। যুগের পর যুগ পার হলেও কোনো আধুনিকতার ছোঁয়া লাগেনি এ কাজে।

তবে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। এক যুগ আগেও একটি টমটম বিক্রি হতো ৫-৭ টাকায়। আর এখন একটি টমটম তৈরিতে খরচ হচ্ছে গড়ে সাত টাকা পর্যন্ত।

ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, সারা বছর দেশের কোথাও না কোথাও মেলা চলে। আর এ খেলনার চাহিদা থাকায় একটি টমটম বিক্রি হয় গড়ে ২০ টাকা পর্যন্ত। একজন কারিগর সপ্তাহে ৪শ’ টমটম বানাতে পারে। এ ব্যবসায়ে বৈশাখ মাসে বছরের সবচেয়ে বেশি বেচাকেনা হয়। আর বর্ষার সময় কয়েক মাস বসে থাকতে হয় তাদের।

ওই গ্রামের কারিগর মো. আফজল ফকির (৭০) জানান, ছোট বেলা থেকে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে শুরু হওয়া এ কাজ আজও করছেন তিনি। আর নিজেই তৈরির পাশাপাশি অন্যের থেকে কিনেও ব্যবসা বাড়িয়েছেন। সবই হাতে করা এ কাজে কোনো অনীহা নেই আফজল ফকিরের।

সংসারের সব কাজ শেষে আবার আয় রোজগার বাড়াতে টমটম তৈরি করেন খোলাশ গ্রামের গৃহবধূ জাহানারা বেগম। স্বামী আকতার মোল্লা একজন টমটম ব্যবসায়ী। তিনি জানান, তার স্বামী সারা বছর ব্যবসার কাজে দেশের বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে বেড়ান। চাহিদা বাড়ায় দাম বেশি হওয়ায় পরিবারের ছোট-বড় সবাই টমটম তৈরির কাজে অত্যন্ত দক্ষ।

ফরিদপুর, সিরাজগঞ্জের এনায়েতপুর, নরসিংদী, কুমিল্লার হোমনা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নোয়াখালীর কাঞ্চনপুর ও চট্টগ্রামের লালদীঘিসহ খুলনা আর উত্তরাঞ্চলের বগুড়া, রাজশাহী, নওগাঁ, দিনাজপুর ও রংপুরে বড় বড় মেলায় সরবরাহ করা হয় টমটম।

খেলনা বিক্রি করে সংসার কোনো মতে চললেও পুরোনো এ ব্যবসা বাদ দিতে চান না মো. বক্স ফকিরের মতো অনেকেই। মো. শাহ আলম, গৃহবধূ দেলোয়ারা ও শাহারা বেগমসহ অনেকেই এ কাজ করে সংসারের হাল ধরেছেন। হস্ত শিল্পের এ কাজে সরকারি কোনো সহযোগিতা না পেলেও বাঙালির প্রাচীন এ সংস্কৃতি ধরে রাখতে চান গ্রামের সবাই।

তবে সরকারি কোনো ঋণের সুবিধা পাওয়া যায় কি-না তা কখনো চেষ্টা করে দেখেননি এ গ্রামের বাসিন্দারা। কিন্তু বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা (এনজিও) থেকে অনেকেই ঋণ নিয়েছেন। আর চড়া সুদে এসব ঋণ নিয়ে অনেকেই এখন চরম দারিদ্র্যের সঙ্গে লড়ছেন।

পুরোনো এ ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারের সহযোগিতা আশা করছেন টমটম ব্যবসায়ী মো. ছানোয়ার হোসেন। তিনি জানান, গ্রামের অনেককে সহযোগিতা করার জন্য ব্যবসায়ী সমিতি চালু করা হয়েছে। আর এখান থেকে আর্থিকভাবে নানা ঋণের ব্যবস্থা করা হয়েছে।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন (বিসিক) বগুড়ার উপ-মহাব্যবস্থাপক (ভারপ্রাপ্ত) এ. কে. এম মাহফুজুর রহমান জানান, খোলাশ গ্রামে এমন হস্তশিল্প রয়েছে তা জানা নেই। তবে তাদের আগ্রহ থাকলে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণের ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ বিসিকের সুবিধা নিতে চাইলে তা দেওয়া হবে।

তিনি আরো জানান, এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত অনেকেই আর্থিকভাবে সচল না হওয়ায় তাদের ঋণের বিষয় সম্পর্কে আগে জানাতে হবে। কাজের কর্ম দক্ষতা ও ব্যবসা বাড়াতে বিসিকের পক্ষ থেকে পরিদর্শন করে তাদের সুবিধার বিষয়গুলো বিবেচনা করা হবে।

মন্তব্য

Beta version