-->

হরমোন পদ্ধতিতে আনারস চাষে দ্বিগুণ লাভ

অরণ্য জুয়েল, রাঙামাটি
হরমোন পদ্ধতিতে আনারস চাষে দ্বিগুণ লাভ
রাঙামাটি শহরের বনরূপা সমতাঘাটে কাপ্তাই হৃদে ভাসমান বাজারে বিক্রির জন্য ইঞ্জিন নৌকায় আনারস নিয়ে আসেন চাষিরা

আনারসের মৌসুম শুরু সাধারণত মে থেকে জুনের দিকে। কিন্তু পাহাড়ে ঘটছে এর ব্যতিক্রম। হরমোন পদ্ধতিতে চাষ করে মৌসুম শুরুর অন্তত চার মাস আগেই ফলন পেয়েছেন রাঙামাটির কৃষকরা। এতে গ্রীষ্ম মৌসুমের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি লাভ হওয়ায় জেলার অনেক চাষি এখন আগাম আনারস ফলাচ্ছেন।

রাঙামাটির বাজার এখন রসালো ফল আনারসে ভরপুর। ভালো দামও পাচ্ছেন কৃষকরা। চাহিদা থাকায় এসব আনারস যাচ্ছে চট্টগ্রাম ও ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায়। এতে খুশি পাইকার ও ভোক্তারাও।

রাঙামাটি জেলায় সাধারণত ‘হানিকুইন’ ও ‘জায়েন্ট কিউ’ নামে দুটি জাতের আনারস চাষ হয়ে থাকে। এর মধ্যে হানিকুইন জাতের আনারসই ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। আর আগাম ফলনের জন্য আনারসে ফুল আসার পর এবং ফলন ধরার পর এতে বড় আকারের জন্য দুবার হরমোন প্রয়োগ করে থাকেন কৃষকরা।

স্বল্পমাত্রায় হরমোন প্রয়োগ করলে মানবদেহে ক্ষতিকর প্রভাব পড়ে না বলে জানিয়েছে কৃষি বিভাগ।রাঙামাটি কৃষি সম্প্রসারণ বিভাগ জানিয়েছে, ‘গত মৌসুমে জেলায় আনারসের আবাদ হয়েছে ২ হাজার ১৩০ হেক্টর পাহাড়ি ঢালু জমিতে। আর আনারস উৎপাদিত হয়েছে ৫৫ হাজার ৩৮০ টন।

এবার আনারসের চাষ করা হয়েছে ২ হাজার ১৩৫ হেক্টর জমিতে। হেক্টর প্রতি ২৬ টন হিসেবে প্রায় ৫৫ হাজার ৫১০ টন আনারস উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে।

জেলার ১০ উপজেলাতেই আনারস উৎপাদন হয়। তবে নানিয়ারচর উপজেলার ইসলামপুর, বুড়িঘাট ও সদর উপজেলার কুতুকছড়ি, তৈমেদুং, বড়মহাপুড়ম, বন্দুকভাঙ্গা ও পুদিহালী এলাকায় আনারসের চাষ হয় বেশি।

এসব স্থান থেকে উৎপাদিত আনারস কৃষকেরা ছোট ছোট ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে রাঙামাটি শহরের সমতাঘাট, পৌরসভা ট্রাক টার্মিনাল, কলেজ গেট ও রিজার্ভ বাজারে নিয়ে আসেন। সেখান থেকে ঢাকা ও চট্টগ্রামের পাইকারি ব্যবসায়ীরা কিনে এসব আনারস ট্রাকে করে বিভিন্ন জেলায় সরবরাহ করেন।

আনারস চাষিরা জানান, নভেম্বর থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে জঙ্গল পরিষ্কার করে পাহাড়গুলো চাষের উপযোগী করতে হয়। চারা রোপণ করতে হয় জানুয়ারি থেকে মার্চের মধ্যেই। প্রায় এক বছর পর আসে আনারসের ফলন। কিন্তু হরমোন প্রয়োগ পদ্ধতিতে সাত থেকে আট মাসের মধ্যে ফলন আসে। এজন্য আনারসের চারা রোপণের চার থেকে পাঁচ মাস পর হরমোন প্রয়োগ করতে হয়।

শহরের কয়েকজন ফল ব্যবসায়ী জানান, নানিয়ারচর উপজেলা ও রাঙামাটি সদর উপজেলায় আগাম আনারসের চাষ ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। দিন দিন চাষির সংখ্যা বাড়ছে। অনেক পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ী আগাম আনারসের ক্ষেত কিনে নেন।

এ ছাড়া চাষিরা ক্ষেত থেকে আনারস তুলে নানিয়ারচর বাজার, ঘিলাছড়ি ও সদর উপজেলায় কুতুকছড়ি, ঘাগড়া এবং রাঙামাটি শহরের তবলছড়ি, বনরূপা বাজারে বিক্রি করছেন। এখান থেকেও পাইকাররা ঢাকা ও চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে আনারস সরবরাহ করছেন।

শহরের বনরূপা সমতাঘাটে কাপ্তাই হ্রদে ভাসমান বাজারে গিয়ে দেখা যায়, চাষিরা বিক্রির জন্য ইঞ্জিন নৌকায় আনারস এনেছেন বাজরে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা চাষিদের কাছ থেকে আনারস কিনে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় পাঠাতে ট্রাকে বোঝাই করছেন।

প্রতি জোড়া বড় আনারস বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়। আর ছোট ও মাঝারি আকারের বিক্রি হচ্ছে ৮ থেকে ১২ টাকা জোড়া।

বাজারে আসা নানিয়ারচর এলাকার আনারস চাষি তপন জ্যোতি চাকমা জানান, করোনার কারণে গত দুই মৌসুমে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। তবুও চলতি মৌসুমের জন্য ১৫ হাজার আনারস গাছ লাগিয়েছিলেন। এবার ফলন ও দামও ভালো পেয়েছেন। তাই নতুন করে আরো ২৫ হাজার চারা লাগিয়েছেন। একই এলাকার আলোময় চাকমা জানান, আনারসে লাভ বেশি। আয়-রোজগারও ভালো। তাই চাষিরা এদিকে ঝুঁকছে।

ব্যবসায়ী রতন পাল জানান, বাজারে আগাম আনারস আসায় চাহিদা বেশি। এতে তারও বেশ মুনাফা হয়েছে। ঢাকায় পাঠাতে এরই মধ্যে কয়েক হাজার আনারস সংগ্রহ করেছেন তিনি।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক তপন কুমার পাল বলেন, ‘আগাম ফলন ও গাছের বৃদ্ধিতে চাষিরা সরকার অনুমোদিত ‘গ্রোথ হরমোন’ প্রয়োগ করে। এতে তিন থেকে চার মাস আগে ফলন আসে।’

তিনি আরো বলেন, ‘স্বল্পমাত্রায় হরমোন প্রয়োগ করলে মানবদেহে ও পরিবেশের ক্ষতি হয় না। এজন্য স্থানীয় কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ ও নজর রাখা হচ্ছে।’

তিনি বলেন, ‘মৌসুমের চেয়ে এ সময় আগাম ফলন আসায় আনারস দ্বিগুণ দামে বিক্রি হয়। চাষিরা অনেক লাভবান হন।’

এই হরমোন প্রয়োগে মানব শরীরে কোনো নেতিবাচক প্রভাব পড়ে কিনা তা জানাতে পারেননি রাঙামাটি জেলা সিভিল সার্জন ডা. বিপাশ খিসা। তিনি বলেন, ‘হরমোন প্রয়োগের বিষয়ে আমার কোনো ধারণা নেই। কৃষি বিভাগ বিষয়টি বলতে পারবে।’

মন্তব্য

Beta version