-->
শিরোনাম
সুনামগঞ্জে বাঁধ ভেঙে ঢুকছে পানি

‘বাঁধ গেল, নিয়ে গেল ধানও’

মোসাইদ রাহাত, সুনামগঞ্জ
‘বাঁধ গেল, নিয়ে গেল ধানও’

‘১৫ দিন ধরে বাঁধে কাজে ছিলাম। সোমবার জমির পাকা ধান কাটব বলে ঠিক করে রাখি। এরমধ্যেই বাঁধটি ভেঙে সারা বছরের কষ্ট বিফলে গেল। এখন কীভাবে সারা বছর খেয়ে বেঁচে থাকব।’

কথাগুলো বলছিলেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার সন্তোষপুরের কৃষক রণি সরকার। রোববার (১৭ এপ্রিল) বিকেল ৪টায় টাঙ্গুয়া হাওরের ওয়াচ টাওয়ারের পাশের অংশ ভেঙে হাওরে এমন বিপর্যয় দেখা দেয়। ভেঙে যায় ধর্মপাশা ও তাহিরপুরের হাজারো কৃষকের স্বপ্ন। হাওরপাড়ের পাঠাবুকা, ভবানীপুর, সন্তোষপুর, মানিকটিলা, রামসিংহপুর, লামাগাঁও, উক্তিয়ারগাঁও, নোয়াগাঁওসহ অসংখ্য গ্রামের কৃষকরা এ সময় আহাজারি করতে থাকেন।

রোববার সকালে হঠাৎ করে বাঁধের একাংশ দেবে উপর দিয়ে পানি প্রবেশ করতে থাকে। হাওরে পানি ঢুকতে থাকলে নিরুপায় হয়ে যান বাঁধের কাজে থাকা কৃষকসহ সংশ্লিষ্ট সকলেই। কৃষকরা বাঁধ ছেড়ে হাওরের দিকে ছুটতে থাকেন, জমিতে থাকা নিজের পাকা ধান ঘরে তুলে আনার চেষ্টা ছিল তাদের। সেই চেষ্টাও বৃথা যায়। কিছুক্ষণের মধ্যে ভেসে যায় হাওর।

ওই গ্রামের রতন সরকার জানান, গত দুদিন ধরেই চিন্তা করছিলেন আধাপাকা ধানই কেটে নেবেন। কিন্তু বাঁধের অবস্থা খারাপ হওয়ায় ওখানে কাজে ছিলেন। এখন বাঁধও গেল, সঙ্গে নিয়ে গেল ধানও।

অশ্রুসিক্ত নয়নে বললেন, ‘অখন গাঁও (গ্রাম) ছাইড়া টাউনে যাওন লাগব, নাইলে কাম (কাজ) পাইতাম (পাবো) নায়, খাইয়াও বাঁচতাম নায় (বাঁচব না)।’

বাঘমারা ও নোয়াল বাঁধ দুটি টাঙ্গুয়ার হাওর সংলগ্ন বর্ধিত গুরমার দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নে অবস্থিত, যা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) যথাক্রমে ২৩ ও ২৭ নম্বর প্রকল্পের অন্তর্ভুক্ত। বর্ধিত গুরমা ফসল রক্ষা বাঁধ নামে ২৮টি প্রকল্প রয়েছে। এর মধ্যে একটি বাঁধের যেকোনো অংশ ভেঙে গেলেই ফসল রক্ষা বাঁধের সবগুলো প্রকল্পই অকার্যকর হয়ে পড়ে।

সংশ্লিষ্ট ইউনিয়ন পরিষদ সূত্রে জানা যায়, বাঁধ দুটি ভেঙে যাওয়ায় গলগলিয়া, নোয়াল, কাউয়ার বিল, কাউজ্জাউরি, গাঁওর কিত্তা (ভবানীপুর), কলমা ও শালদিঘা হাওরের আবাদ করা বছরের একমাত্র ফসল বোরো ধান তলিয়ে যাবে। এসব হাওরে তাহিরপুর উপজেলার দক্ষিণ শ্রীপুর ও মধ্যনগর উপজেলার দক্ষিণ বংশীকুণ্ডা ইউনিয়নের আট হাজার ৩০০ একর জমির ধান আবাদ করেছেন। এর মধ্যে তাহিরপুর অংশে ছয় হাজার একর আর মধ্যনগর অংশে দুই হাজার ৩০০ একর।

কৃষকরা জানিয়েছেন, তাহিরপুর অংশে চার হাজার ৫০০ একর আর মধ্যনগর অংশে ৬০০ একর জমির আধাপাকা ধান কাটা হয়েছে। এসব হাওরে তাহিরপুর উপজেলার ভবানীপুর, মানিকখিলা, দুমাল, লামাগাঁও, হুকুমপুর, রামসিংহপুর, সন্তোষপুর গ্রামের কৃষকরা এবং মধ্যনগর অংশে কাউয়ানি, মাকড়দি, বিশরপাশা, নিশ্চিন্তপুরসহ ১০টি গ্রামের কৃষকরা ধানের আবাদ করেছেন।

তবে বাকি জমির ধান রক্ষায় উপজেলা প্রশাসন দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়নের লামাগাঁও গ্রামের পার্শ্ববর্তী গাঙ্গের মুখের বাঁধ মজবুত করতে দুপুর থেকে কাজ শুরু করেছেন।

মোয়াজ্জেমপুরের কৃষক প্রভাত সরকার। বললেন, ‘ফসল কাটা শুরু হয়েছিল কেবল, এরমধ্যেই কপাল ভাঙল আমাদের।’

এই বাঁধটি ২০১৭ সালের বন্যার আগ পর্যন্ত নির্মাণ হতো ইউনিয়ন পরিষদের আর্থিক সহায়তায়। এক সময় উন্নয়ন সংগঠন সিএনআরএস’এর আর্থিক সহায়তায়ও বাঁধটি নির্মাণ করেছেন কৃষকরা।

চার দিন আগে বাঁধ রক্ষার কাজে থাকা কৃষকরা বলেছিলেন, বাঁধটি নদীর পাড়ঘেঁষে করায় এই বিপদ হয়েছে। নির্মাতাদের ভুলে হাজারো কৃষকের ঘুম হারাম হয়েছে।

রামসিংহপুরের কৃষক তারা মিয়া বলেন, ‘স্নোপের অংশে বেশি মাটি দেখাতে বাঁধটি পাড়ের অংশ থেকে সরিয়ে নদীর দিকে আনা হয়েছে। নদীতে পানি আসার পরই বাঁধ দেবে যায়। বিপদ হয় আমাদের। বাঁধের পিআইসি ও যারা তদারকির দায়িত্বে ছিল তাদের বিচার হওয়া জরুরি।’

কৃষকরা জানালেন, বাঁধে ধস ও ফাটল দেখা দেওয়ার পর যেভাবে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা এসেছেন বাঁধ নির্মাণের সময় সেভাবে দেখা যায়নি।

মধ্যনগর উপজেলার দক্ষিণ বংশীকুণ্ডা ইউনিয়ন পরিষদ (ইউপি) চেয়ারম্যান রাসেল আহমেদ বলেন, ‘আমরা সবাই মিলেই বাঁধ রক্ষায় সব ধরনের চেষ্টাই করেছি। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি।’

দক্ষিণ শ্রীপুর ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান আলী আহমদ মুরাদ বললেন, ৩ এপ্রিল থেকে বাঁধ রক্ষার লড়াই শুরু করেছিলাম। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং জেলা প্রশাসকসহ জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারাও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। শেষ পর্যন্ত পারলাম না। রোববার সকালে বাঁধের ২৭ নম্বর পিআইসি অংশ দেবে যায়। প্রথমে ওপর দিয়ে পানি প্রবেশ শুরু হয়। কয়েকঘণ্টা এভাবে পানি যেতে যেতে বিকেল ৪ টায় বাঁধটি ভেঙে ডুবে যায় হাওর।

রোববারও বাঁধ রক্ষার লড়াইয়ে উপস্থিত ছিলেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জেলা স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক জাকির হোসেন বলেন, বাঁধটি রক্ষার জন্য গত ১৫ দিন হয় দিনে রাতে পালাক্রমে অবস্থান ছিল জেলা প্রশাসক, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ সকলের। কিন্তু শেষপর্যন্ত ঠেকানো গেলো না বাঁধ। এখন অন্য বাঁধগুলো রক্ষার চেষ্টা করছেন তারা।

তাহিরপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) রায়হান কবির বলেন, ‘বর্ধিত গুরমা বাঁধ রক্ষায় প্রতিকূল আবহাওয়ার মধ্যেই সবাই মিলে রাতদিন কাজ করেছি। কিন্তু আজ (রোববার) বিকেল ৪টায় বাঁধের দুটি স্থান ভেঙে যায়। এখন কিছু জমি বাঁচাতে লামাগাঁও বাজার ও দুমাল গ্রামের মধ্যের বাঁধটি আরো মজবুত করতে কাজ করছি।’

বিপদসীমার উপর দিয়ে বইছে ধনু নদীর পানি

নেত্রকোনা প্রতিনিধি জিয়াউর রহমান জানিয়েছেন, ভারতের চেরাপুঞ্জিতে ভারী বর্ষণের ফলে উজান থেকে নেমে আসা ঢলে আবারো বৃদ্ধি পেয়েছে নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি। বিশেষ করে জেলার খালিয়াজুরী উপজেলার ধনু নদীর পানি বিপদসীমার অনেক উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। রোববার দুপুরে নেত্রকোনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাইবো) নির্বাহী প্রকৌশলী মোহন লাল সৈকত ভোরের আকাশকে এ তথ্য নিশ্চিত করেন।

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে (বিকেল) ধনু নদীর পানি বিপদসীমার ১৫ সেন্টিমিটার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তবে কীর্তণখোলা ফসল রক্ষা বাঁধ অতিক্রম করে মূল হাওরে পানি প্রবেশ করার তেমন কোনো আশঙ্কা আপাতত দেখছি না।’

স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে পানি উন্নয়ন বোর্ডের লোকজন কীর্তণখোলা ফসল রক্ষা বাঁধে অবস্থান করছেন জানিয়ে তিনি দাবি করেন, ‘এরই মধ্যে হাওরাঞ্চলের তিন উপজেলা মদন, মোহনগঞ্জ ও খালিয়াজুরীর শতকরা ৬২ ভাগ বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে।’

জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, জেলার ১০ উপজেলায় এ বছর এক লাখ ৮৪ হাজার হেক্টরেরও বেশি জমিতে বোরোর আবাদ হয়েছে। এর মধ্যে শুধু হাওরাঞ্চলে বোরো আবাদ করা হয় ৪০ হাজার ৯৩০ হেক্টর জমিতে।নেত্রকোনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক এফএম মোবারক আলী বলেন, ‘৩৩২টি কম্বাইন হারভেস্টার মেশিন ও ১০ হাজারের মতো কৃষি শ্রমিক হাওরাঞ্চলের বোরো ধান কাটার কাজে ব্যস্ত রয়েছেন। এরই মধ্যে হাওরাঞ্চলের শতকরা ৬২ জমির বোরো ধান কাটা হয়ে গেছে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় এবং উজান থেকে নেমে আসা ঢলে দ্বিতীয় দফায় ধনু নদীসহ হাওরের অন্যান্য নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা কৃষকদের ৮০ ভাগ পাকা ধান কেটে ফেলার তাগিদ দিয়ে আসছি। আশা করছি দ্রুত কৃষকরা তাদের হাওরের ফসল ঘরে তুলতে পারবেন।’

এর আগে প্রথম দফায় নেত্রকোনার হাওরাঞ্চলের নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পেয়ে জেলার খালিয়াজুরী ও মদন উপজেলার কয়েকটি হাওরের অন্তত ৫০০ একর নিচু জমির বোরো ধান পানিতে তলিয়ে যায়। এ তথ্য দিয়ে এফএম মোবারক আলী বলেন, ‘তখন ধনু নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় খালিয়াজুরীর কীর্তণখোলা ফসল রক্ষা বাঁধের কয়েকটি স্থানে ফাটল ও ধস দেখা দেয়। এতে চরম ঝুঁকিতে পড়েছিল হাওরের ফসল রক্ষার বিষয়টি। তবে জেলা প্রশাসন, জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড, জেলা কৃষি বিভাগ স্থানীয় উপজেলা, জনপ্রতিনিধি ও স্থানীয় কৃষকদের সঙ্গে নিয়ে বাঁধ মেরামত করে ঝুঁকি মোকাবিলা করে।’

কথা হলো খালিয়াজুরী উপজেলার কীর্তণখোলা ফসল রক্ষা বাঁধ সংলগ্ন চাকুয়া গ্রামের কৃষক মৃদুল মিয়ার সঙ্গে।

তিনি বলেন, ‘প্রথম পর্যায়ে ধনু নদীর পানি বেড়ে আমাদের নিচু এলাকার অনেক বোরো ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। বাঁধেও ফাটল দেখা দেওয়ায় আমরা দিনরাত কাজ করে বাঁধ মেরামত করেছি। এরই মধ্যে ফসল হারানোর ভয়ে আমরা কাঁচা ও আধা পাকা ধান কেটে ঘরে তুলছি।’

তিনি বলেন, ‘আবারো ধনু নদীর পানি বাড়ছে। এ অবস্থায় যেকোনো সময় বাঁধ ডিঙিয়ে পানি হাওরে ঢুকতে পারে। এতে যেসব ধান এখনও কাটা বাকি রয়েছে- সেগুলো পানিতে তলিয়ে যেতে পারে।’

মন্তব্য

Beta version