-->
শিরোনাম

টঙ্গিবাড়ীতে আরেকটি প্রত্নবস্তুর সন্ধান

মঈনউদ্দিন সুমন, মুন্সীগঞ্জ প্রতিনিধি
টঙ্গিবাড়ীতে আরেকটি প্রত্নবস্তুর সন্ধান
মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে অবস্থিত হাজার বছরের প্রাচীন নাটেশ্বর বৌদ্ধনগরীতে সদ্য আবিষ্কৃত পঞ্চম অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপ

মুন্সীগঞ্জের টঙ্গিবাড়ীতে অবস্থিত হাজার বছরের প্রাচীন নাটেশ্বর বৌদ্ধনগরীতে আরো একটি প্রত্নবস্তুর সন্ধান পাওয়া গেছে। এটি হলো পঞ্চম নিদর্শন, যা দেখতে অষ্ট-কোণাকৃতির।

আর সদ্য আবিষ্কৃত এই পঞ্চম অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপে রয়েছে ধর্ম চক্র। সেই ধর্ম চক্রটিতে আটটি স্পোক রয়েছে। প্রতিটি স্পোকের সংখ্যা বৌদ্ধধর্মের প্রতীকী অর্থে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। পঞ্চম স্তূপের আদি পর্যায়ের অষ্ট-কোণাকৃতি স্তূপের দেয়ালের গাঁথুনি এখনো অপূর্ব মসৃণ। দেখে মনে হয় যেন আধুনিক সিরামিকের ইটের গাঁথুনি। সদ্য সন্ধান পাওয়া এই নিদর্শন দেশের প্রত্নতাত্ত্বিক ইতিহাসে বিরল।

মূলত ২০১৩ সালে নাটেশ্বর দেউলে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশন প্রত্ন উৎখননের কাজ শুরু হয়। এর আগে খননের মধ্য দিয়ে অষ্ট-কোণাকৃতির চারটি স্তূপ আবিষ্কৃত হয়।

গত শনিবার দুপুরে সন্ধান পাওয়া প্রত্ন স্থাপনাটি সরেজমিনে পরিদর্শন করেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ গবেষণা ও খননকাজে জড়িতরা। পরে এ উপলক্ষে সংবাদ সম্মেলন ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আবুল মনসুর।

বিক্রমপুর অঞ্চলে প্রত্নতাত্ত্বিক খনন ও গবেষণা প্রকল্প পরিচালক এবং বিক্রমপুর অঞ্চলে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি ড. নূহ-উল-আলম লেনিনের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মহাপরিচালক রতন চন্দ্র পণ্ডিত, টঙ্গিবাড়ী উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জগলুল হালদার ভুতু, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রুমানা তানজিন অন্তরা, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক রাখী রায়, উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক কবির হালদার প্রমুখ।

লিখিত বক্তব্যে অগ্রসর বিক্রমপুর ফাউন্ডেশনের সভাপতি নূহ-উল-আলম লেনিন জানান, বিক্রমপুরের নাটেশ্বর দেউলে এবারের আবিষ্কার বাংলাদেশের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পঞ্চম স্তূপের আদি পর্যায়ের অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপের দেয়ালের গাঁথুনি এখনো অপূর্ব মসৃণ, মনে হয় যেন আধুনিক সিরামিক ইটের গাঁথুনি।

সত্যিই দেয়ালের ইট, পরিমাপ, গাঁথুনি- সেও আবার কাদামাটির মর্টার, তবুও অসাধারণ দক্ষতার পরিচয় বহন করে। ৭.৪ গুণ ৭.৪ পরিমাপের একটা বর্গাকার ভিত্তির ওপর উলম্বভাবে ইট স্থাপন করে অনেকটা গরুর গাড়ির চাকার ন্যায় ধর্মচক্র নির্মাণ করা হয়েছে। ইতিপূর্বে আবিষ্কৃত প্রথম ও চতুর্থ অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপে আদি পর্যায়ে ধর্মচক্রের আভাস দেখা দিয়েছিল। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ের অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপ দ্বারা আবৃত থাকায় সে রহস্য উন্মোচিত হয়নি। সদ্য আবিষ্কৃত পঞ্চম অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপের ধর্মচক্রটিতে আটটি স্পোক রয়েছে। প্রতিটি স্পোকের সংখ্যা বৌদ্ধধর্মে প্রতীকী অর্থে ভিন্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে।

নূহ-উল-আলম লেনিন জানান, নাটেশ্বরে আবিষ্কৃত অষ্ট-কোণাকৃতির পঞ্চম স্তূপে আটটি স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র বৌদ্ধধর্মের মূল অষ্টাঙ্গিক মার্গ দর্শনকে দ্বিগুণ করে প্রতিফলিত করেছে। বৌদ্ধধর্মে কোনো একক পূজণীয় হিসেবে ধর্মচক্র প্রাচীনকাল থেকেই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচিত হয়।

বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন হলো চার আর্যসত্য যথাক্রমে জীবনে দুঃখ আছে, দুঃখের কারণ আছে, দুঃখের বিনাশ আছে এবং দুঃখ বিনাশের উপায়ও আছে। দুঃখ বিনাশের উপায়গুলো হচ্ছে- সৎদৃষ্টি, সৎসংকল্প, সৎবাক্য, সৎকর্ম, সৎজীবিকা, সৎচিন্তা, সঠিক চৈতন্য এবং সৎধ্যান অনুশীলন করা।

বৌদ্ধধর্মে অষ্টমঙ্গল হিসেবেও আটটি প্রতীক কল্পনা করা হয়, যার মধ্যে ধর্মচক্র অন্যতম। ধর্মচক্রকে সূর্য রশ্মির সঙ্গেও তুলনা করা হয়।

সংবাদ সম্মেলনে তিনি আরো জানান, নিরেট ভিত্তিভূমিতে আট স্পোকবিশিষ্ট ধর্মচক্রের ওপর হাজার বছরের প্রাচীন হলঘর বা মণ্ডপসহ অষ্ট-কোণাকৃতির স্তূপের উপস্থিতি এর আগে বাংলাদেশ কেন, ভারতবর্ষের অন্য কোথাও পাওয়া যায়নি। নাটেশ্বর দেউলে আবিষ্কৃত কেন্দ্রীয় অষ্ট-কোণাকৃতি মন্দির, বর্গাকৃতির স্তূপ, একাধিক অষ্ট-কোণাকৃতি স্তূপ, স্তূপের স্মারক কক্ষে বর্গাকার, অষ্টকোণা ও গোলাকার প্রতীকী স্থাপত্য, আট স্পোকযুক্ত ধর্মচক্র সবই বৌদ্ধধর্মের মূল মন্ত্রের প্রতীকী রূপ।

নাটেশ্বর দেউলে প্রায় সব স্থাপত্যে প্রতীকীরূপে বৌদ্ধধর্মের মূল দর্শন ফুটিয়ে তোলার এমন নজির আর কোথাও নেই। পণ্ডিত অতীশ দীপংকরের জন্মভূমি বিক্রমপুরের নাটেশ্বর দেউলে সাম্প্রতিক আবিষ্কৃত প্রতীকী স্থাপত্যগুলো দেখে মনে হয় যে, প্রায় ১১০০ বছর আগে বিক্রমপুরে বৌদ্ধধর্ম এবং দর্শনের একটি অত্যন্ত সমৃদ্ধিশালী স্কুল বিকাশ লাভ করেছিল। সে কারণে হয়তো তৎকালীন তিব্বতী রাজা অনেক অনুনয়-বিনয় করে বৌদ্ধধর্ম রক্ষায় পণ্ডিত অতীশ দীপংকরকে তিব্বতে নিয়ে যান।

সংবাদ সম্মেলন শেষে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের অধ্যাপক ও ঐতিহ্য অন্বেষণের নির্বাহী পরিচালক ড. সুফি মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বিক্রমপুরে অতীশ দীপংকরের জন্মভূমি। রঘুরামপুর থেকে নাটেশ্বরে প্রত্নতত্ত্ব ভূমি। ২০১০ সালে রঘুরামপুরে খনন করেছি। ২০১৩ সালে নাটেশ্বরে খনন শুরু করি। এবার ২০২১-২২ সালে সর্বশেষ খননে অষ্ট-কোণাকৃতির পঞ্চম স্তূপ আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছি। আগামী দুই বছর এখানে খনন চলবে। এরপর আবিষ্কৃত নিদর্শন সংরক্ষণ করা হবে।’

মন্তব্য

Beta version