হাওরাঞ্চলের প্রবেশপথ খ্যাত কিশোরগঞ্জের ভৈরব। বিশাল হাওরাঞ্চলসহ এখানকার নদ-নদী ও খাল বিলের মিঠাপানিতে এক সময়ে দেশীয় মাছে ভরা ছিল। তবে বিগত কয়েক বছরে অঞ্চলটিতে মিঠাপানি মাছ আশঙ্কাজনক হারে কমে গেছে। ফলে বাজারে মাছের দাম চলে যাচ্ছে ক্রেতা-সাধারণের নাগালের বাইরে।
অন্যদিকে জেলার মৎস্যজীবীরা মানবেতর জীবনযাপন করছেন। তবে স্থানীয় মৎস্য বিভাগ বলছে, মুক্ত জলাশয় অর্থাৎ নদী-নালার মৎস্য সম্পদ কমে এলেও বৃদ্ধি পাচ্ছে বদ্ধ জলাশয়ে মাছের আবাদ। জিহ্বার স্বাদ কমে এলেও পুষ্টির কোনো ঘাটতি হবে না এখানকার অধিবাসীদের।
কিশোরগঞ্জের বিশাল হাওরাঞ্চলসহ ভৈরবে এক সময় মাছের ভাণ্ডার বলে পরিচিত ছিল। ভৈরবসহ আশপাশের বড় নদ-নদী, হাওর-বাঁওড়, নালা, খাল-বিলে তারা বাইম, কৈলাশ, কালী বাউশ, চিতল, নানীন, ভাচাঁ, গাওরা, গাগলা, পাবদা, বাগাই, রিডা, পুমা, লাচু, টেকা, কাজলী, বেদী বা মিনি, কাদলা, কাইক্কা, পাঙাশ, মৃগেল, শিং, মাগুর, কৈ, চান্দা, বাইল্লা, টেংরা, বাতাসি বা আলনি মাছ, বইছা, গুতুম, চিকরা, চাপিলা, রানী বা রানদী, ভূম মাছ, আকস মাছ, পান মাছ, মাসুল মাছ, কোরাল মাছ, তিতপুঁটি, কাচকিসহ ২৬০ প্রজাতির মিঠাপানির মাছের সহজ লভ্যতা ও প্রাচুর্যতা ছিল। খেতে স্বাদ ভালো হওয়ায় এখানকার মাছের কদর ছিল পুরো দেশে।
কিন্তু যতই সময় পার হচ্ছে এখানকার মাছের ভাণ্ডারের শূন্যতাও দেখা দিচ্ছে। এরই মধ্যে অনেক প্রজাতির মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। অনেকটি আবার প্রায় বিলুপ্তির পথে।
স্থানীয় মৎস্যজীবীরা জানান, আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ মাছও নেই নদী-নালা, খাল-বিলে। তাই তারা সারাদিন শিকার করেও দুইশ’ টাকার বেশি মাছ পান না। মাছ না থাকায় বাড়ির ঘাটে সারাদিন অলস বাঁধা থাকে তাদের মাছ শিকারের নৌকাগুলো।
এ ছাড়া দ্রব্যমূল্যের অসহনীয় বাজারদরে তারা পরিবার-পরিজন নিয়ে কষ্টে দিন কাটাচ্ছেন। অন্য কোনো উপায় না থাকায় এ পেশায় লেগে আছে বলেও জানান তারা।
নদীতে সময়মতো পানি না আসা, পোনা মাছ নিধন, অবৈধ জাল দিয়ে মাছ শিকার ও এক শ্রেণির লোভী এবং অসাধু মাছ ব্যবসায়ীর জন্য মাছ কমে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন সাধারণ জেলে ও সুধী সমাজ। তারা আরো জানান, জলাশয় ভরাট, কৃষি জমিতে মাত্রাতিরিক্ত কীটনাশকের ব্যবহার, জলবায়ু পরিবর্তন, কল-কারখানার বর্জ্য, মাছের আবাসস্থল বিনষ্ট, সেচ দিয়ে মাছ ধরে ফেলাসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক কারণে মাছ কমে যাচ্ছে।
ভৈরবের কালিপুর গ্রামের আবু কালাম বলেন, ‘এক সময় আমরা জাল ও বরশি ছাড়াও ডুব দিয়ে বিল থেকে মাছ ধরতাম। যে জায়গায়ই বরশি দিয়ে লর ফেলতাম সেই জায়গায় মাছ ধরত। কিন্তু এখন আর সেই দিন যেমন নেই তেমননি সেই জায়গাও নেই। সব বালু দিয়ে ভরাট করে ফেলছে।’
কালিপুর গ্রামের ইসমাইল বলেন, ‘আগে বাজারে যেই মাছ একটু বেশি আমদানি হতো সেই মাছ ব্যবসায়ীরা আর কিনত না। সেগুলো তারা নদীতে ফেলে দিত। তখন সবার ঘরে ঘরে মাছ থাকত। কিন্তু এখন আর সেই দিন নাই। মাছ তো দূরের কথা মাছের গন্ধও পাওয়া যায় না সহজে।’
নয়াহাটি গ্রামের লিবৃন্দ্র বলেন, ‘শৈশবে দেখতাম পানির ওপর দিয়ে ঝাঁকে ঝাঁকে মাছ ভেসে বেড়াত। এখন সেই দৃশ্য কল্পনায়ও ভাসে না।’
ওই গ্রামের সুরেশ বর্মণ বলেন, ‘১৫-২০ বছর আগে এক ঘণ্টা জাল টানলে এক-দেড় মণ মাছ উঠত। এখন দিন-রাতেও এর সিকি ভাগও হয় না। প্রভাবশালী মহল মাঝ নদীতে খেউ আর বাঁধ দিয়ে ও পাটিজাল পেতে মাছ শিকার করে। তাদের ধারে কাছেও যেতে পারে না জেলেরা।’
পৌর শহরের পুরোনো ফেরিঘাটের পংকু মিয়ার মাছ বাজারের বেপারী পুষন বলেন, ‘৪০-৪৫ বছর ধরে মাছের ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। এ অঞ্চলে মাছের এমন আকাল আমাদের চোখে আর পড়েনি। দিন যতই যাচ্ছে দেশীয় মাছের সংকট আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। জলে মাছ নেই। বাজারে মাছের আমদানি কম। আগের তুলনায় চারভাগের একভাগ দেশি মাছও এখন আমদানি হয় না। ব্যবসা নেই। তাই লাভও হয় না।’
তবে ভিন্ন মত ভৈরব সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা লুতিফুর রহমানের। তিনি বলেন, ‘এ উপজেলায় চারটি নদ-নদী, ১৮টি বিল ছাড়াও ছোট-বড় ১৪৫০টি পুকুর রয়েছে। এগুলো থেকে ছয় হাজার ৬২০ দশমিক ৮০ টন মাছ উৎপাদন হয়। উদৃব্দ থাকে সাত টন মাছ।’
তিনি আরো বলেন, ‘ভৈরবের সঙ্গে মাছের একটা সম্পর্ক রয়েছে। তবে এখানে যে হাওর বা নদীনালা রয়েছে সেখানে প্রাকৃতিক মাছগুলো বিভিন্ন কারণে কিছুটা কমে গেছে। এক্ষেত্রে সরকারিভাবে আমরা মৎস্য অধিদপ্তরের মাধ্যমে বিভিন্ন কার্যক্রম গ্রহণ করেছি। আর আমাদের একটি অভায়শ্রম রয়েছে এবং আরো দুটি অভায়শ্রমের জন্য প্রস্তাব পাঠিয়েছি। যদি এই প্রস্তাব সফল হয় তাহলে আশা করি মৎস্য উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।’
মন্তব্য