এক সময় দেশের বিভিন্ন জলাশয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যেত কাজলি, গাঙ ট্যাংরা, ঘারুয়া ও বাইলা। আর তিস্তা নদীতে মিলত জারুয়া, বোল, আঙরা ও কুর্শা মাছ। জলাশয় সংকোচন, পানি দূষণ, প্রজননক্ষেত্র ধ্বংস ও অতি আহরণের ফলে এসব মাছ বর্তমানে বিপন্নের তালিকায়।
বেশ কিছুদিন ধরেই এসব দেশীয় মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ব্যাপক পোনা উৎপাদনের চেষ্টা করছেন বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীরা। এর ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মধ্যে মাছগুলোর কৃত্রিম প্রজনন-কৌশল উদ্ভাবনের চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে তারা।
ব্যাপক পোনা উৎপাদন হলে সারাদেশে চাষাবাদের জন্য ছড়িয়ে দেওয়া হবে অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ দেশীয় প্রজাতির এই মাছগুলো। এতে বাজারে সহজলভ্য হবে বিপন্নের তালিকায় এসব মাছ। ফের বাঙালির খাবার টেবিলে ফিরবে দেশীয় মাছগুলো।
বাঙালিদের বলা হয়, মাছে-ভাতে বাঙালি। তবে দিন দিনই বাঙালির পাতে কমে যাচ্ছে দেশি মাছ। ব্যাপক দূষণ ও অতিরিক্ত আহরণসহ নানা কারণে দেশি মাছের অনেক প্রজাতি বিলুপ্ত হয়ে গেছে। আরো বহু প্রজাতি হুমকির মুখে।
তবে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় বদলাতে শুরু করেছে অবস্থা। আর এই অবস্থা পরিবর্তনে মুখ্য ভূমিকা রেখেছে ময়মনসিংহে অবস্থিত বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা।
কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে ইতোমধ্যে বিলুপ্তপ্রায় ৩২ প্রজাতির দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদনে সফলতা পেয়েছে বিএফআরআই। এর মধ্যে প্রজনন ও চাষাবাদ কৌশল উদ্ভাবনের সবশেষ সংযোজন হলো দারকিনা। এ মাছটি নিয়ে ২০২১ সালের শুরুতে গবেষণা চলে। গবেষণার ধারাবাহিকতায় গত মার্চ মাসের শেষদিকে ইনস্টিটিউটের স্বাদুপানি কেন্দ্রে এ মাছের প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা এসেছে।
বিএফআরআই ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘কৃত্রিম প্রজননের জন্য বিলুপ্তপ্রায় মাছ পুকুর, বিভিন্ন জলাশয়, হাওর-বাঁওড় কিংবা নদী থেকে সংগ্রহ করা হয়। এরপর দীর্ঘ গবেষণার ধারাবাহিকতায় একপর্যায়ে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়।
‘অক্সিজেন সরবরাহের জন্য ঝরনার মাধ্যমে পানির প্রবাহের ব্যবস্থা করা হয়। ইনজেকশন দেওয়ার নির্দিষ্ট সময় পর ডিম দেয় মাছগুলো। এরপর ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে। রেণু বের হওয়ার পর হাঁপাতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা রাখতে হয়। এভাবে ডিম থেকে উৎপাদিত রেণুপোনাকে পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। সেখান থেকেই প্রচুর পরিমাণ পোনা উৎপাদন করা হয়।’
মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা জুলফিকার আলী বলেন, ‘দেশীয় মাছের প্রাপ্যতা কমে যাওয়ার কারণে সংরক্ষণের জন্য লাইভ জিন ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছে। যেসব মাছের হারিয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে, সেগুলো সংগ্রহ করে লাইভ জিন ব্যাংকে রাখা হয়। পরে গবেষণা করা হয়।’
তিনি আরো বলেন, ‘দেশে স্বাদুপানির ২৬০ প্রজাতির মাছের মধ্যে ১৪৩ প্রজাতির ছোট মাছ রয়েছে। এর মধ্যে বিলুপ্তপ্রায় মাছের সংখ্যা ৬৪টি। ইতোমধ্যে দারকিনাসহ ৩২ প্রজাতির মাছের পোনা কৃত্রিম প্রজননে উৎপাদন করা হয়েছে। এর মধ্যে ১৯ প্রজাতির মাছ সারাদেশে চাষের আওতায় এসেছে। বাকিগুলো চাষের আওতায় আনাসহ বিলুপ্তপ্রায় মাছের পোনা উৎপাদন করতে গবেষণা চলছে।’
সম্প্রতি দারকিনা মাছের কৃত্রিম প্রজননে সাফল্য পাওয়া গবেষণক দলের প্রধান ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আউয়াল বলেন, ‘দারকিনা মাছের পুষ্টিগুণ অন্যান্য ছোট মাছের তুলনায় অনেক বেশি। প্রতি ১০০ গ্রাম ভক্ষণযোগ্য মাছে ভিটামিন-এ ৬৬০ মাইক্রোগ্রাম আরএই, ক্যালসিয়াম ৮৯১ মি. গ্রাম, আয়রন ১২ দশমিক শূন্য মিলিগ্রাম এবং জিংক ৪ মিলিগ্রাম পাওয়া যায়।’
তিনি বলেন, ‘বাজারে দারকিনা মাছ খুব একটা চোখে পড়ে না। হঠাৎ পাওয়া গেলেও ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। মাছটির জিনপুল সংরক্ষণের মাধ্যমে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, নার্সারি ব্যবস্থাপনা ও চাষ কলাকৌশল উদ্ভাবন করা প্রয়োজন। এই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে গবেষণায় মাছটির প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা পাওয়া যায়। এ ছাড়া দেশীয় প্রজাতির সবগুলো ছোট মাছই অধিক পুষ্টিসমৃদ্ধ। ফলে সবগুলো মাছ খাবার টেবিলে ফেরাতে পারলেই আমাদের সার্থকতা।’
পরিসংখ্যান মতে, ২০০৮-০৯ সালে চাষের মাধ্যমে দেশীয় মাছের উৎপাদন ছিল ৬৭ হাজার টন। দেশীয় মাছের পোনা উৎপাদন ও চাষাবাদ প্রযুক্তি উদ্ভাবন হওয়ায় ২০২০-২১ সালে উৎপাদন চারগুণ বেড়ে আড়াই লাখ টনে উন্নীত হয়েছে।
বিএফআরআই মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘দেশীয় প্রজাতির মাছগুলোয় প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন, ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, লৌহ ও আয়োডিনের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ পদার্থ আছে। এগুলো শরীরের রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে এবং রক্তশূন্যতা, গলগণ্ড ও অন্ধত্বের মতো রোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে।’
মন্তব্য