-->
শিরোনাম

পাদুকা কারিগরদের ব্যস্ত সময়

ভৈরব (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি
পাদুকা কারিগরদের ব্যস্ত সময়
কিশোরগঞ্জের ভৈরবের একটি কারখানায় শ্রমিকরা কাজ করছেন

ঈদ উপলক্ষে কিশোরগঞ্জের ভৈরবে পাদুকা কারখানাগুলোয় ব্যস্ত সময় পার করছেন পাদুকাশিল্পের কারিগররা। দুই চোখে ঘুম নেই তাদের, দিন-রাত এক করে কাজ করছেন তারা। বাড়তি লাভের আশায় সারা বছর কারিগররা এ সময়ের জন্য অপেক্ষা করেন। নিপুণ হাতের তৈরি এসব পাদুকার চাহিদা রয়েছে দেশের বিভিন্ন জায়গায়।

কারখানার মালিকরা বলছেন, দেশে করোনা পরিস্থিতিতে গত দুই বছরে পাদুকাশিল্পের উপকরণ আমদানি বন্ধ ছিল। এ জন্য দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম বেড়েছে কয়েকগুণ। ফলে জুতা তৈরিতে খরচ আগের তুলনায় বেশি হচ্ছে।

১৯৯৫ সাল থেকে উপজেলার কালিকাপ্রসাদ গ্রামের আদি কারিগর মৃত ইব্রাহীম মিয়ার হাত ধরেই ভৈরবে এ পাদুকাশিল্পের যাত্রা শুরু হয়। পুরান ঢাকা থেকে জুতার কারখানা নিজ এলাকায় স্থানান্তরের মাধ্যমে ভৈরবে প্রথমে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। ঢাকায় উৎপাদন ব্যয় বেশি ও চাঁদাবাজির হাত থেকে রক্ষায় ভৈরবে কারখানা স্থানান্তর হলেও ক্রমেই তা বড় হয়ে আজ ঢাকাকে ছাড়িয়েছে বহু বছর আগে।

বর্তমানে উপজেলার কমলপুর, শম্ভুপুর, শিবপুর, গজারিয়া ও কালিকাপ্রসাদে প্রায় ১০ হাজারের বেশি কারখানায় অন্তত ৬০ হাজার পাদুকা কারিগর কাজ করছেন। ঈদকে সামনে রেখে এসব কারখানায় বেড়েছে কাজের চাপ। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িতরা জানান, ইন্ডিয়ান ও চায়না পাদুকার আগ্রাসনে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে এ শিল্প।

ভৈরবের কমলপুর এলাকার ডায়মন্ড সু কারখানার মালিক বাচ্চু মিয়া জানান, গত দুই বছরে যে পরিমাণ ক্ষতি হয়েছে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে চলতি বছর পুরোদমে কারখানায় পাদুকা উৎপাদন চলছে। তবে পাদুকা তৈরির উপকরণের দাম যে হারে বেড়েছে, সে তুলনায় জুতার দাম বাড়েনি। ফলে বেচাবিক্রি নিয়ে কিছুটা দুশ্চিন্তা কাজ করছে।

সম্প্রতি ভৈরবের পাইকারি বাজারে ঘুরে হাজী মার্কেট, মিজান মার্কেট, আজিজ সুপার মার্কেট, হাজি বশির মার্কেট, ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক ঘেঁষে জগন্নাথপুর গ্রামসংলগ্ন শহীদুল্লাহ কায়সার ও কাঞ্চন মিয়া মার্কেট, গোধূলি সিটি মার্কেটে, হাজী লাল মিয়া, কালু মিয়া ও কালাম মার্কেটসহ বেশ কয়েকটি বড় মার্কেট আছে শুধু জুতা বিক্রির জন্য। এসব মার্কেটে অন্তত তিন হাজার পাইকারি দোকান রয়েছে বলে জানিয়েছেন পাদুক ব্যবসায়ীরা।

ভৈরবের অধিকাংশ কারখানাতেই সাধারণ মানের জুতা তৈরির দৃশ্য দেখা গেছে। ১২০০ থেকে ১৫০০ টাকায় এক ডজন বা প্রায় ১৫০ থেকে ২০০ টাকা জোড়ায় পাইকারি বিক্রি উপযোগী জুতা তৈরি করছে ৮০ ভাগ কারখানা। শিশুদের জুতার ক্ষেত্রে তা জোড়াপ্রতি ৪০ থেকে ৫০ টাকায় রয়েছে। উপকরণ হিসেবে প্লাস্টিক, ফোম ও রেক্সিন ব্যবহার করছে অধিকাংশ কারখানা।

তবে ক্রেতাদের চাহিদা অনুসারে সব ধরনের জুতা উৎপাদন করেন বলে দাবি করছেন স্থানীয় কারিগর ও কারখানার মালিকরা। ভৈরবের হাজী মার্কেটের চায়না সু ফ্যাক্টরির মালিক লিটন মিয়া বলেন, ভৈরবে এখন স্যান্ডেল, পেনসিল হিল, ফ্ল্যাট হিলসহ বিভিন্ন ধরনের জুতা তৈরি হচ্ছে। চামড়াসহ সব ধরনের ভ্যারাইটির জুতা তৈরি হয়। তবে দামের ওপর নির্ভর করে এর মান।

এছাড়া অধিকাংশ কারখানায় সাধারণ মানের জুতা তৈরি হলেও দেশের বিখ্যাত ব্র্যান্ড ও উন্নত মানের জুতা তৈরি করতে দেখা গেছে অনেক কারখানায়।

হাজী বশির মার্কেটের চৌধুরী সুজের মালিক জানান, এ বছর ভৈরবের জুতার মার্কেট গত বছরের তুলনায় কিছুটা ভালো রয়েছে। ভৈরবের তৈরি জুতা কিনতে বিভিন্ন জেলার পাইকারি বিক্রেতারা ভিড় করছেন। চলতি বছর অন্যান্য বছরের তুলনায় পাদুকা কারখানায় বাহারি রকমের নতুন নতুন ডিজাইনের জুতা উৎপাদন করা হয়েছে বলে জানান তিনি।

তবে মজুরি না বাড়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন পাদুকা তৈরির কারিগর আবুল বাশার। তিনি বলেন, ‘দেশে যে হারে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, সে তুলনায় আমাদের কাজের মজুরি বাড়েনি। সারাদিন কাজ করে মজুরি পাই ৫০০ থেকে ৬০০ টাকা। অথচ সংসারে বাজার খরচ লাগে ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা। স্বল্প মজুরি দিয়ে সংসার চালাতে আমাদের কষ্ট হচ্ছে।’

ময়মনসিংহ থেকে জুতা কিনতে এসেছেন পাইকারি ব্যবসায়ী আব্দুল হাই। তিনি বলেন, প্রতি বছরই ঈদের মৌসুমে ভৈরবের জুতা কিনতে আসি। এখানকার উৎপাদিত জুতা খুবই উন্নতমানের এবং দেশব্যাপী এর ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। তবে এ বছর জুতার দাম বেশি বলে দাবি করেন তিনি।

ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সবুজ মিয়া বলেন, করোনার কারণে গত দুই বছর জুতাশিল্পের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। তবে এবার যেহেতু পরিস্থিতি স্বাভাবিক, তাই বড় পরিসরে জুতা উৎপাদন করা হচ্ছে।

তিনি আরো বলেন, এ বছর জুতা তৈরির উপকরণের দাম অস্বাভাবিকভাবে বেড়েছে। ফলে প্রতিটি জুতা তৈরিতে উৎপাদন খরচ গড়ে ৫০ থেকে ৬০ টাকা বেড়েছে। এ কারণে জুতা বিক্রি কমে গেছে। জুতা তৈরির উপকরণের মূল্যবৃদ্ধির জন্য আমদানিকারক সিন্ডিকেটকে দায়ী করে এ বিষয়ে সরকারের সহযোগিতা কামনা করেন এ ব্যবসায়ী নেতা।

ভৈরব পাদুকা কারখানা মালিক সমিতির সভাপতি আল-আমিন মিয়া বলেন, ভৈরবের পাদুকাপল্লি এখন দেশের জুতার চাহিদা মেটাচ্ছে। বিশেষ করে ঈদ এলেই এই চাহিদা অনেকগুণ বেড়ে যায়। সবচেয়ে বড় কথা, এ খাতের সঙ্গে অর্ধলাখের বেশি মানুষ জড়িত। কিন্তু ভারতীয় ও চায়না জুতায় আজ দেশের এই শিল্প ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেশীয় এ শিল্প রক্ষায় সরকারের সুদৃষ্টি কামনা করেন তিনি।

মন্তব্য

Beta version