বিনামূল্যে কৃষকদের মাঝে সরকারি সার-বীজ বিতরণ চলছিল। তবে সেখানে নামধারী কৃষক ছিল বেশি। কৃষি কর্মকর্তাদের সামনেই সার-বীজ তুলে লাইনের পাশের ডিলার ‘একতা ট্রেডার্সে’ বিক্রি করছিল তারা। ঘটনাটি জানাজানি হলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ডিলারের গোডাউন থেকে ৩০ বস্তা সরকারি সার জব্দ করা হয়।
তবে ওই ডিলারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। গত বৃহস্পতিবার ময়মনসিংহের ত্রিশালে বিনামূল্যে সরকারি সার-বীজ বিতরণকালে এমনটি ঘটে।
কৃষকদের প্রশ্ন, জমি থাকলে তো সার বিক্রি করার কথা না?
তাদের অভিযোগ, প্রান্তিক কৃষকদের জন্য বিনামূল্যে সরকারি বরাদ্দের সার এবং বীজ প্রকৃত কৃষকরা পাচ্ছেন না। ভুয়া নামধারী কৃষকরা কৃষি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আঁতাত করে কার্ড সংগ্রহ করেছেন এবং সার ও বীজ তুলে নিচ্ছেন। হাত ঘুরে ওই সার-বীজ চলে যাচ্ছে ডিলারদের গুদামে।
কৃষকরা জানান, উপজেলার ১২টি ইউনিয়নের বেশিরভাগ প্রকৃত কৃষক সরকারি এ সুবিধা থেকে বঞ্চিত। যাদের জমি নেই তারা সরকারি এ সুবিধা পাওয়ার তালিকায় স্থান পেয়েছেন। কৃষি অফিসের অসাধু কর্মকর্তা ও স্থানীয় জনপ্রতিনিধির মাধ্যমে নাম তুলেছেন তারা। এরপর বিনামূল্যের সার-বীজ উত্তোলন করে কম টাকায় ডিলারদের গুদামে নিয়ে বিক্রি করছেন। এতে ঠকছেন প্রকৃত কৃষকরা।
উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, উপজেলায় আউশ মৌসুমের জন্য সরকারিভাবে তিন হাজার ৬৪০ জন সুবিধাভোগী কৃষককে প্রণোদনা দেওয়ার জন্য নামের তালিকা তৈরি করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বাররা। একেকজন কৃষক প্রতি বিঘা ধান চাষের জন্য পাঁচ কেজি উফশী বীজ, দেড় কেজি হাইব্রিড বীজ, ২০ কেজি ডিএপি সার এবং ১০ কেজি এমওপি সার পাওয়ার কথা রয়েছে। এগুলো বিতরণের জন্য গত সোমবার আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যক্রম উদ্বোধন করে উপজেলা কৃষি অফিস।
অনুসন্ধানে জানা যায়, এ উপজেলার প্রত্যেকটি ইউনিয়নে তিনজন করে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা দায়িত্বে থাকার কথা থাকলেও ২৪ জন উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা কাজ করছেন। সরকারি নিয়ম অনুযায়ী, প্রকৃত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করার কথা থাকলেও তারা তা করেননি। সরেজমিনে কৃষকদের সঙ্গে কথা না বলে কিংবা মাঠে না গিয়ে জনপ্রতিনিধিদের দ্বারস্থ হয়েছেন তারা। যে যেভাবে বলেছেন, সেভাবেই তারা সরকারি তালিকায় নাম তুলেছেন। ফলে কখনো কৃষিকাজ করেনি এমন লোকও সরকারি সুবিধা ভোগ করছেন।
বৈলর ইউনিয়নের কৃষক আব্দুল বাতেন ২১০ শতাংশ জমিতে আউশ আবাদ করেন। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমাকে কৃষি কার্ড দেওয়া হয়নি। বিনামূল্যে পাওয়া তো দূরের কথা, ডিলারদের কাছ থেকে চড়ামূল্যে সার ও বীজ কিনতে হচ্ছে। সরকারের প্রণোদনা বা বিনামূল্যে সার-বীজ কখনো চোখে দেখিনি।’
স্থানীয় আবেদ আলী, মোহাম্মদ আলী, ফজলুল হক, জয়নাল আবেদীন, জালাল উদ্দিন, আব্দুল আজিজ ও আমানুল্লাহ নামে কয়েকজন কৃষক জানান, একেকজন ১৮-৬০ কাঠা পর্যন্ত জমিতে চাষাবাদ করেন। কিন্তু তারা কেউ কৃষি কার্ড পাননি। কখন কার্ড দেওয়া হয়েছে তারা তাও জানেন না। প্রকৃত কৃষকদের সরকারি এই সুবিধার আওতায় আনা হয়নি।
খোঁজখবর না নিয়ে যাদের জমি খুব কম কিংবা নেই, জমি থাকলেও চাষ করেন না- তাদের নাম এ তালিকায় লেখা হয়েছে। এতে তারা এগুলো উত্তোলন করে নামমাত্র দামে ডিলারের কাছে বিক্রি করে দিচ্ছেন। এরপর সরকারি বরাদ্দের এসব সার-বীজ অন্য কৃষকদের কাছে চড়ামূল্যে বিক্রি করেন ডিলাররা।
ডিলার আনিসুজ্জামানের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, ‘কৃষি অফিসের সামনে কৃষকদের নিকট থেকে সারগুলো ক্রয় করা হয়েছিল। নগদ টাকা দিয়ে সার ক্রয় করেছি। তারা প্রকৃত কৃষক কিনা আমার জানার কথা নয়। এরা কাদের সঙ্গে আঁতাত করে কার্ড সংগ্রহ করেছে, তাও আমার জানা নেই।’
অভিযোগের বিষয়ে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা তানিয়া রহমান বলেন, ‘নিয়ম অনুযায়ী উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তারা সরেজমিন গিয়ে প্রকৃত কৃষকদের তালিকা প্রস্তুত করবেন। এরপর তালিকা অনুযায়ী আমরা কার্ডের মাধ্যমে সার-বীজ বিতরণ করব। কিন্তু অনেক সময় স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বিভিন্ন লোকের নাম দিয়ে কৃষক বলে তালিকায় নাম তুলতে বলেছেন। তখন তাদের কথা বিশ্বাস করে যাচাই-বাছাই ছাড়াই অনেকের নাম উঠে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘অনেক কৃষক বিনামূল্যের সার-বীজ উত্তোলন করে আমাদের অজান্তে বিক্রি করে দেয়। তবে বিতরণের প্রথম দিন হাতেনাতে আমরা ডিলারের গুদাম থেকে ৩০ বস্তা সার জব্দ করেছি। তার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
কৃষকের জমি থাকলে উত্তোলন করা সার-বীজ বিক্রি করবেন কেন- এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা চেষ্টা করেছি প্রকৃত কৃষকদের মাঝে এগুলো বিতরণ করার জন্য। তবু তালিকা অনুযায়ী সার-বীজ পাওয়া ব্যক্তিদের জমি সম্পর্কে আবারো খোঁজখবর নেওয়া হবে। ভুল করে তালিকায় নাম ওঠা ব্যক্তিদের বাদ দেওয়া হবে। আমরা চাই প্রকৃত কৃষকরাই সরকারি এই সুবিধার আওতায় আসুক।’
ত্রিশাল উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তারুজ্জামান বলেন, ‘সরকারি বরাদ্দের সার ডিলারের গুদাম থেকে জব্দ করার ঘটনা শুনেছি। প্রকৃত কৃষকরা বঞ্চিত হয়েছে কিনা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে খোঁজখবর নেওয়া হবে। অসাধু ডিলারদের বিরুদ্ধেও যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
মন্তব্য