-->
শিরোনাম

পরিত্যক্ত প্লাস্টিকে ভাগ্য বদল

কামরুল হাসান, সাভার (ঢাকা)
পরিত্যক্ত প্লাস্টিকে ভাগ্য বদল
প্লাস্টিকের বেল্ট থেকে তৈরি হচ্ছে ধান সংরক্ষণের গোলা

ধামরাই উপজেলার সুয়াপুর ইউনিয়নের রৌহা গ্রামের বিশ্বনাথ। আগে গরু লালন-পালন করতেন তিনি। কিন্তু গো-খাদ্যের দাম বৃদ্ধি হওয়ায় সেই ব্যবসায় ক্ষতি হয়। এরপর নিজের বুদ্ধিতেই গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি করছেন ধান সংরক্ষণের গোলা, ঘরের চাল, বেড়া এবং কবুতরের খোপসহ দৈনন্দিন ব্যবহার্য নানান হস্তশিল্প। এসবের একটি কারখানাও দিয়েছেন তিনি। যেখানে বর্তমানে কাজ করছেন ৮-১০ জন শ্রমিক।

উদ্যেক্তা বিশ্বনাথ বলেন, ‘গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের এই বেল্টগুলো দেখে আমার মাথায় আসে এগুলো দিয়েও বাঁশ বা বেতের মতো বিভিন্ন ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরি করা সম্ভব। সেই থেকেই এই কাজের শুরু। প্রায় ৫ বছর আগে এই ব্যবসাটা শুরু করেছি। বর্তমানে সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে এই ব্যবসা করে আমি এখন স্বাবলম্বী। আমার এখানে সিজনভেদে সারা বছর ৮-১০ জন শ্রমিক কাজ করে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা বিভিন্ন গার্মেন্টস কারখানা থেকে এই পরিত্যক্ত বেল্টগুলো কেজি দরে কিনে আনি। মানভেদে প্রতিকেজি প্লাস্টিকের বেল্টের দাম ৩০-৬৫ টাকা পর্যন্ত হয়ে থাকে। আর সেই বেল্ট দিয়ে তৈরি বিভিন্ন পণ্য মান অনুযায়ী ১০০-১৫০টাকা পর্যন্ত প্রতিকেজি হিসেবে বিক্রি করে থাকি। দামে কম ও সুন্দর দেখতে হওয়ায় দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে এর চাহিদা।’

বিশ্বনাথের দেখাদেখি ওই গ্রামের কয়েকজন পরিত্যক্ত প্লাস্টিক দিয়ে নানান হস্তশিল্প তৈরি করছেন। প্লাস্টিক দিয়ে তৈরি হলেও এগুলো দেখতে অনেকটা বাঁশ ও বেতের তৈরি পণ্যের মতো। এগুলো বুনাও হচ্ছে বাঁশ ও বেতের মতো করেই। তাই গ্রামীণ জনপদের নারী-পুরুষ সামান্য প্রশিক্ষণের মাধম্যেই তৈরি করতে পারছেন এসব পণ্য।

সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, সুয়াপুর বাজারে বিশ্বনাথ চন্দ্রের ‘লোকনাথ সৌরভ স্টোরের’ দেখাদেখি এমন আরো ৩-৪টি প্লাস্টিকের বেল্ট থেকে বিভিন্ন পণ্য তৈরির প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। তারা উপজেলার বিভিন্ন গার্মেন্টসের পরিত্যক্ত প্লাস্টিকের এসব বেল্ট কেজি দরে কিনে আনেন। পরে স্থানীয় কারিগররা তাদের নিপুণ হাতে তৈরি করেন গৃহস্থালির নানান ব্যবহার্য সামগ্রী। এতে করে একদিকে যেমন পরিবেশ মুক্ত হচ্ছে দূষণের হাত থেকে অন্যদিকে কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে।

এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটিতে কাজ করছেন গড়ে ৮-১০ জন শ্রমিক। আর তাদের তৈরি করা এসব পণ্য স্থানীয় বাজারের চাহিদা মিটিয়ে পৌঁছে যাচ্ছে পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ, গাজীপুর, টাঙ্গাইলসহ দেশের নানা প্রান্তে।

এসব পণ্য তৈরির বিষয়ে কথা হয় সুমা দাশ নামে এক নারী কারিগরের সঙ্গে। তিনি ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমাদের মজুরি দেয়া হয় কেজি হিসেবে। প্রতি কেজি পণ্য তৈরির জন্য মজুরি হিসেবে পায় ২৫ টাকা। দৈনিক প্রায় ১০ থেকে ১২ কেজি পণ্য বুনতে পারি। প্রতি মাসে প্রায় ৮-৯ হাজার টাকা আয় হয়।’

স্বামীর পাশাপাশি সুমা দাশের বাড়তি আয় দিয়েই চলছে তাদের তিন সন্তানের লেখাপড়ার খরচ। আগে নিজ বাড়ির গৃহস্থালি কাজ করেই তার সারাদিন কাটতো। ছিল না বাড়তি কোনো আয়ের মাধ্যম। এর ফলে সংসারে অভাব-অনটন লেগেই থাকতো। তবে বর্তমানে কাজ করে তিনি এখন স্বাবলম্বী। স্বামীর পাশাপাশি নিজেও মিটাচ্ছেন সংসারের খরচের একটি অংশ।

আশু সরদার নামে আরেক কারিগর বলেন, ‘আমি প্রায় ১৮ বছর যাবত এই কাজ করছি। আগে ধানের গোলা এবং বেড়া বুনতাম বাঁশের কঞ্চি দিয়ে। এখন আর বাঁশ দিয়ে বুনি না। প্লাস্টিকের এই ফিতা দিয়ে এসব পণ্য বানাই।

‘আর কয়েক দিন পর থেকেই ধান কাটার মৌসুম শুরু হবে। সে উপলক্ষে এখন ধানের গোলার অনেক চাহিদা। বছরের এই তিন মাস এখানকার কারিগররা দিন-রাত কাজে ব্যস্ত সময় পার করে। এই সময় দৈনিক ৮০০- এক হাজার টাকাও আয় হয়। এ ছাড়া বছরের অন্য সময়ে আমরা ঘরের সিলিং, বেড়া, কবুতরের খোপসহ বিভিন্ন ব্যবহার্য সামগ্রী তৈরি করে থাকি।’

আপন মনে প্লাস্টিকের বেড়া বুনছিলেন ষাটোর্ধ্ব নির্মল সরকার। তাকে জিজ্ঞেস করতেই জানালো, একসময় ভ্যান চালিয়ে সংসার চালাতেন তিনি। এখন বয়সের কারণে ভ্যান টানার শক্তি নেই। ছেলেরাও বিয়ে করে আলাদা সংসার পেতেছে। তাই এই কাজ করেই স্ত্রীসহ দুজনের আহার যোগাড় করেন তিনি।

নির্মল সরকার বলেন, ‘বৃদ্ধ হবার কারণে কেউ কাজে রাখতে চাইতো না। পরে বিশ্বনাথের কাছে আসলে তিনি আমাকে এখানে কাজে রাখেন। কয়েকদিন হাতে ধরে দেখিয়ে দেবার পর এখন আমি নিজেই বেড়া বুনতে পারি। এটা দিয়েই আমার আয় হয়, সংসারের খরচ চলে।’

পার্শ্ববর্তী মানিকগঞ্জ জেলা থেকে ধানের গোলা কিনতে আসা সাহেব আলী নামের এক কৃষক বলেন, ‘আমি মাঝারি সাইজের ধান সংরক্ষণের গোলা কিনেছি। যার ওজন হয়েছে ৩০ কেজি। ১২০ টাকা দরে দাম হয়েছে ৩৬০০টাকা। এই গোলাটি অনেক টেকশই সহজে নষ্ট হবে না।

‘আমরা আগে বাঁশের তৈরি গোলায় ধান রাখতাম। তবে ইঁদুরের জন্য সেগুলো বেশিদিন ব্যবহার করা যেত না। ফলে অনেক ধান নষ্ট হয়ে যেত। কিন্তু এখানকার প্লাস্টিকের তৈরি গোলায় ধান রাখলে তা সহজে নষ্ট হয় না ও ইঁদুরেও কাটতে পারবে না।’

বিশ্বনাথের এই কারখানার পাশেই প্লাস্টিকের বেড়া দিয়ে তৈরি ঘরে বসবাস মাধবী দাসের। তিনি বলেন, ‘টিন কিংবা ইটের ঘর তৈরিতে অনেক খরচ। আমাদের সেই সামর্থ্য নেই তাই প্লাস্টিকের বেড়া দিয়ে ঘর বানিয়েছি। এতে খরচ তুলনামূলক অনেক কম। রোদ বৃষ্টিতে নষ্ট হবারও কোনো আশঙ্কা নেই। এই ঘরে থাকতে কোনো অসুবিধাই হয় না। সাধারণ টিনের ঘরের মতোই ভেতরের পরিবেশ। তেমন কোনো পার্থক্য নেই।’

মন্তব্য

Beta version