-->
শিরোনাম

রাতে অবৈধভাবে চলছে বাল্কহেড, ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার শঙ্কা

জহির রায়হান, বরিশাল ব্যুরো
রাতে অবৈধভাবে চলছে বাল্কহেড, ঈদযাত্রায় দুর্ঘটনার শঙ্কা
ছবি: সংগৃহীত

নৌপথগুলোতে নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে রাতে বাল্কহেড চলাচল করছে। দক্ষ মাস্টারের পরিবর্তে অদক্ষ সুকানি দিয়ে বাল্কহেড চলাচলে প্রায়ই ঘটছে যাত্রীবাহী নৌযানের সঙ্গে সংঘর্ষ ও প্রাণহানির ঘটনা। এসব ঘটনা সামনে রেখে এবার ঈদযাত্রায় চলাচলে দুর্ঘটনা নিয়ে শঙ্কিত যাত্রী সাধারণ ও লঞ্চ কর্তৃপক্ষ।

বিআইডব্লিউটিএ সূত্রে জানা গেছে, নৌপথে যাত্রীবাহী লঞ্চ-স্টিমার ও জাহাজের যাত্রা নিরাপদ করতে রাতে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার নির্দেশনা রয়েছে। তবে রাতে বাল্কহেডসহ পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়নি বলে দাবি করেছেন লঞ্চের মাস্টাররা।

সরকারি হিসেব অনুযায়ী, ৪ হাজার ৭০০টি নিবন্ধিত বাল্কহেডের কথা বলা হলেও সারাদেশে নদীতে চলছে ১০ হাজারের বেশি বাল্কহেড। এসব বাল্কহেড রাতে মেঘনা, পদ্মা, আড়িয়াল খাঁ, কীর্তনখোলা, সুগন্ধা, বিষখালী, পায়রা, কালবদরসহ বিভিন্ন নদ-নদীতে অবাধে বালু তুলছে বলে জানিয়েছেন লঞ্চ স্টাফরা৷

বিভিন্ন ঘটনার সূত্রে জানা গেছে, গত মাসের ১৮ মার্চ সন্ধ্যার পর ঝালকাঠি থেকে ঢাকাগামী এমভি ফারহান-৭ নামের একটি লঞ্চের সঙ্গে বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষ হয়। এতে বাল্কহেডটি ডুবে যায়। এতে অল্পের জন্য রক্ষা পায় লঞ্চটির তিন শতাধিক আরোহী।

২০ মার্চ নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যা নদীতে সিটি গ্রুপের মালিকানাধীন একটি মালবাহী জাহাজের ধাক্কায় লঞ্চডুবির ঘটনায় এ পর্যন্ত ৮ জনের লাশ উদ্ধার করা হয়।

গত ১৬ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা থেকে বরিশালগামী এমভি সুরভী-৭ নামে একটি লঞ্চের সঙ্গে বাল্কহেডের সংঘর্ষে বাল্কহেডের একজন মারা যান।

৩১ জানুয়ারি চাঁদপুরে ডাকাতিয়া নদীতে বালুবাহী আরেকটি বাল্কহেডের ধাক্কায় মাটিবাহী ট্রলার ডুবে পাঁচজনের মৃত্যু হয়।

গত বছরের ৩ মে মাদারীপুরের শিবচর উপজেলার বাংলাবাজার-শিমুলিয়া নৌপথে কাঁঠালবাড়ী ঘাট–সংলগ্ন এলাকায় বাল্কহেডের ধাক্কায় স্পিডবোট দুর্ঘটনায় ২৬ জনের প্রাণহানি হয়।

গত বছরের ২১ মে রাতে ঢাকা থেকে লালমোহনের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া এমভি গ্লোরি অব শ্রীনগর-২ লঞ্চটির সঙ্গে বালুবাহী বাল্কহেডের সংঘর্ষ হয়। মেঘনায় ঘটে যাওয়া ওই দুর্ঘটনায় লঞ্চটির ডানদিক পানিতে ডুবে গেলে প্রায় আড়াইশ যাত্রীকে নিরাপদে উদ্ধার করা হয়।

এর ঠিক তিন দিন পর ২৪ মে রাতে কয়েকশ যাত্রী নিয়ে বরিশাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করে এমভি মানামী মধ্যরাতে ঝড়ের কবলে পড়ে। মেঘনায় লঞ্চটি যখন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে যায়, তখন হঠাৎ একটি বাল্কহেড ঢেউয়ের তোড়ে লঞ্চটির মাঝ বরাবর হামলে পড়ে। এতে লঞ্চের নিচ তলা ও দ্বিতীয় তলার কেবিনসহ বেশ কিছু অংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয় এবং এক যাত্রী গুরুতর আহত হন।

একই রাতে পটুয়াখালী থেকে ঢাকায় ৩০০ যাত্রী নিয়ে যাওয়ার পথে প্রথমে ঝড়ে ও পরে ভাটার কারণে আটকে পড়ে এমভি যুবরাজ-৭ লঞ্চ। সব প্রতিকূলতা এড়িয়ে সকালে যখন লঞ্চটি যাত্রা শুরু করে, তখন মেঘনা নদীর মিয়ারচরে একটি বাল্কহেড সেটিকে ধাক্কা দেয়। ঘটনার সঙ্গে সঙ্গে তলা ফেটে যায় লঞ্চটির।

বিভিন্ন লঞ্চের একাধিক মাস্টার-চালকরা জানিয়েছেন, এসব বৈধ-অবৈধ বাল্কহেডে রাতের বেলা চলাচলে কোনো নিয়ম মানছে না। কোনো সংকেতবাতি ও সার্চলাইট নেই। পাশাপাশি নেই দক্ষ মাস্টার-চালক।

এছাড়াও পানির নিচে ডুবন্ত থাকায় লঞ্চের উচ্চ ক্ষমতার সার্চলাইটেও এসব বাল্কহেডের অস্তিত্ব বোঝা যায় না। ফলে প্রায়ই এসব ডুবন্ত বাল্কহেড নৌ দুর্ঘটনার কারণ হয়।

এমভি সুন্দরবন লঞ্চের মাস্টার মো. আলম বলেন, ‘ঢাকার ফতুল্লার মোড়ে অধিকাংশ সময় বেশ কয়েকটি ট্যাংকার নোঙর করে রাখা হয়। এতে এই স্থানেরও নৌপথ সরু হয়ে গেছে। এছাড়াও মুন্সীগঞ্জ মোড় থেকে মোহনপুর পর্যন্ত দিনে-রাতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করায় লঞ্চচালকরা সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অভিযান পরিচালনার পর চার/পাঁচ দিন বন্ধ থাকলেও অদৃশ্য ক্ষমতার বলে আবার নদীতে নামে বাল্কহেডগুলো।’

এমভি মানামী লঞ্চের মাস্টার মো. মানিক বলেন, ‘নৌপথ দুর্ঘটনারোধে রাতে অবৈধভাবে নদীতে বালু উত্তোলনকারীদের ঠেকাতে হবে। পাশাপাশি তেমনি যাত্রীবাহী নৌযান চলাচলের পথে রাতে বাল্কহেড-কার্গোসহ ঝুঁকিপূর্ণ নৌযান চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে।’

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআইডব্লিউটিএ) নৌ নিরাপত্তা ও ট্রাফিক বিভাগের বরিশাল অঞ্চলের যুগ্ম পরিচালক, বরিশাল বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘বাল্কহেড নিয়ন্ত্রণের দায়িত্ব নৌ পুলিশের। তারপরও এ বিষয়ে বারবার আমরা চিঠি দিচ্ছি। রাতে বাল্কহেড না চলার বিষয়ে আমরা কাজ করে যাচ্ছি। রাতের আঁধারে নদীতে বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হলেও মানা হচ্ছে না।’

তিনি আরো বলেন, ‘আসন্ন ঈদ উপলক্ষে ঈদের আগে ও পরে ১০ দিন ঢাকা-বরিশাল নৌপথে বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। এ সময়ে যেসব নদ-নদীতে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল করে, সেসব নদ-নদীতে জেলেরাও কোনো জাল ফেলতে পারবেন না বলে বরিশাল জেলা প্রশাসক কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে আয়োজিত আইনশৃঙ্খলার সভায় এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।’

মন্তব্য

Beta version