স্বাদু পানির মাছ ‘শোল’। এক সময় খাল-বিল, হাওর-বাঁওড়, জলধারা ও প্লাবনভূমিতে প্রচুর পরিমাণে শোল মাছ পাওয়া যেত। তবে জলাশয় সংকোচন, পোনা বিনষ্ট, পানি দূষণ এবং অতি আহরণের ফলে মাছটির বিচরণ এবং প্রজননক্ষেত্র বিনষ্ট হওয়ায় এর প্রাপ্যতা কমে গেছে। তবে বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএফআরআই) বিজ্ঞানীদের প্রচেষ্টায় ফের সহজলভ্য হওয়ার পথে মিঠা পানির মাছটি।
দেশীয় প্রজাতির মাছের প্রজনন ও চাষাবাদের ওপর একের পর এক সফলতা অর্জন করছে বিএফআরআই বিজ্ঞানীরা। এবার হ্যাচারিতে শোল মাছের কৃত্রিম প্রজননের মাধ্যমে পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জন করেছেন তারা। চলতি মাসে ইনস্টিটিউটের স্বাদু পানি কেন্দ্রে এ সফলতা অর্জিত হয়।
গবেষক দলে ছিলেন মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী, ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান, বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল, মালিহা খানম, ফারজানা জান্নাত আঁখি ও মো. সাইফুল ইসলাম।
ইনস্টিটিউট সূত্রে জানা যায়, মিঠাপানির দেশীয় প্রজাতির মাছের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় মাছ শোল। মাছটি খেতে সুস্বাদু এবং পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হওয়ায় বাজারে এর চাহিদা প্রচুর। চীন, শ্রীলঙ্কা, ভারত, নেপাল, পাকিস্তানসহ দক্ষিণ পূর্ব-এশিয়ায় এ মাছ পাওয়া যায়। হ্রাস পাওয়ায় বর্তমানে এ মাছের বাজার মূল্য অনেক বেশি।
শোল মাছকে হারিয়ে যাওয়ার হাত থেকে রক্ষা করতে এবং চাষের জন্য পোনার প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে এর কৃত্রিম প্রজনন, পোনা উৎপাদন ও চাষ ব্যবস্থাপনা কৌশল উদ্ভাবনের লক্ষ্যে বিএফআরআই গবেষণা করে আসছিল। চলতি মাসে দেশীয় শোল মাছের কৃত্রিম প্রজনন ও পোনা উৎপাদনে সফলতা অর্জিত হয়। এতে দেশে মোট মৎস্য উৎপাদনে ইতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে মনে করছেন বিজ্ঞানীরা।
মাছটির গবেষক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. রবিউল আওয়াল বলেন, ‘শোল মাছের প্রজননকাল সাধারণত এপ্রিল মাস থেকে শুরু হয়ে অক্টোবরের মাঝামাঝি পর্যন্ত। তবে এপ্রিল থেকে আগস্ট এই মাছের সর্বোচ্চ প্রজনন মৌসুম। পুরুষ মাছের তুলনায় স্ত্রী মাছ আকারে অপেক্ষাকৃত বড় হয়। এ মাছের ডিম্বাশয় এপ্রিল মাস থেকে পরিপক্ব হতে শুরু করে। এপ্রিল মাসে স্ত্রী মাছের জিএসআই মান গড়ে ৫ দশমিক ৩৬ শতাংশ এবং ফেকান্ডিটি (ডিম ধারণক্ষমতা) ১৩০০০-২১০০০। প্রতি গ্রাম স্ত্রী মাছে গড়ে ৮০-৯০টি ডিম পাওয়া যায়।’
তিনি জানান, কৃত্রিম প্রজননের জন্য নেত্রকোনা ও হাওর অঞ্চল থেকে সুস্থ সবল দেশি শোল মাছ সংগ্রহ করা হয়। গবেষণা কেন্দ্রের পুকুরে প্রতি শতাংশে ১০-১২টি হারে মজুদ করা হয়। মজুদকৃত পুকুরে জলজ আগাছা (কচুরিপানা, কলমি লতা, ডালপালা) দেওয়া হয়। মজুদকৃত মাছকে দৈহিক ওজনের ৬-৩ শতাংশ হারে খাবার দেয়া হয়। প্রায় এক বছর পুকুরে লালন পালনের পর কৃত্রিম প্রজননের জন্য এপ্রিল মাসের শুরুতে এর জিএসআই মান দেখে পরিপক্ব স্ত্রী ও পুরুষ মাছ নির্বাচন করে পুকুর থেকে সংগ্রহ করা হয়।
কৃত্রিম প্রজননের ৬-৭ ঘণ্টা আগে স্ত্রী ও পুরুষ মাছ পুকুর থেকে সংগ্রহ করে ছয় জোড়া মাছকে হরমোন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়। ইনজেকশন দেয়ার পর স্ত্রী ও পুরুষ মাছ ১:১.৫ অনুপাতে হ্যাচারিতে রাখা হয়।ইনজেকশন দেয়ার ৩০-৪০ ঘণ্টা পরে স্ত্রী শোল মাছ ডিম দেয়। এ মাছের ডিম পানির ওপরের দিকে ভেসে থাকে। মাছটি স্বজাতিভোজী হওয়ায় ডিম দেয়ার পর ব্রড মাছ দ্রত সরিয়ে ফেলতে হয় এবং অক্সিজেনের সরবরাহ বৃদ্ধি করা হয়। ডিম দেয়ার ৩০-৩২ ঘণ্টার মধ্যে নিষিক্ত ডিম থেকে রেণু বের হয়ে আসে। ডিম থেকে রেণু বের হওয়ার পর হাঁপাতে ৪৮-৭২ ঘণ্টা রাখতে হয়।
রেণুর ডিম্বথলি ৬০-৭০ ঘণ্টার মধ্যে নিঃশেষিত হওয়ার পর প্রতিদিন চার থেকে পাঁচবার মুরগির সিদ্ধ ডিমের কুসুম খাবার হিসেবে হাঁপায় সরবরাহ করা হয়। এ মাছের স্বগোত্রভোজী স্বভাব থাকায় ডিমের কুসুম সিদ্ধ ৪-৫ ঘণ্টা পর পর দিতে হবে। হাঁপাতে রেণু পোনাকে এভাবে ৩-৪ দিন রাখার পর নার্সারি পুকুরে স্থানান্তর করা হয়। গবেষণায় পোনা বেঁচে থাকার সর্বোচ্চ হার ছিল শতকরা ৮৫-৯০ ভাগ।
বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মো. আশিকুর রহমান বলেন, ‘একটি শোল মাছের দৈর্ঘ্য সর্বোচ্চ ১ মিটার এবং ওজনে ৫ কেজি পর্যন্ত হয়ে থাকে। শোল মাছ সাধারণত কর্দমাক্ত ও জলাবদ্ধ স্থান এবং যেখানে জলজ আগাছা রয়েছে এমন স্থানে বেশি পাওয়া যায়। এ মাছের প্রধান আবাসস্থল খাল-বিল ও হাওর-বাঁওড়। শোল মাছ সাধারণত জলাশয়ের নিচের স্তরে বসবাস করে কিন্তু ওপরের স্তরের খাবার গ্রহণ করে। শোল মাছ মাংশাসী শ্রেণির। এরা জুপ্লাংটন, পোকামাকড়, ছোট মাছ, ব্যাঙ, মশার শূককীট এবং জলজ কীটপতঙ্গ শিকার করে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে থাকে। বাজারে বড় এক কেজি শোল মাছের দাম ৭০০ থেকে ৮০০ টাকা।’
তিনি আরো বলেন, ‘শোল মাছের প্রজনন ও চাষ অন্যান্য মাছের তুলনায় অপেক্ষাকৃত জটিল। এরা অন্যান্য মাছের মতো খৈল ও কুঁড়া জাতীয় খাবার খেতে অভ্যস্ত নয়। ফলে পোনা তৈরির জন্য মা-বাবা অর্থাৎ ব্রড মাছ তৈরি করা খুব কষ্টকর বিষয় ছিল। প্রথমে এদেরকে প্রোটিন সমৃদ্ধ দেশীয় একটি খাবারে অভ্যস্ত করা হয়েছে। অতঃপর ব্রড তৈরি করে হরমোন ইনজেকশনের মাধ্যমে পোনা তৈরি করা হয়েছে। এছাড়া এ মাছটি স্বজাতিভোজী হওয়ায় একটি আরেকটিকে ধরে ধরে খায়। ফলে পোনা বাঁচিয়ে রাখাও ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ।’
গবেষক দলের প্রধান ও মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. মো. শাহা আলী বলেন, ‘ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে শোল মাছের নিবিড় চাষ করা হয়। কিন্তু আমাদের দেশে দেশীয় শোল মাছের পোনা না থাকায় এ মাছটিকে চাষের আওতায় আনা সম্ভব হচ্ছিল না। এ মাছের কৃত্রিম প্রজননের জন্য ইনস্টিটিউটটি থেকে দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর চলতি বছরে সফলতা আসে। পোনা উৎপাদিত হওয়ায় শোল মাছকে এখন চাষের আওতায় আনা হয়েছে।’
বিএফআরআই মহাপরিচালক ড. ইয়াহিয়া মাহমুদ বলেন, ‘ইনস্টিটিউটে উদ্ভাবিত প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেশে বর্তমানে পাঁচ শতাধিক হ্যাচারিতে কৃত্রিম উপায়ে দেশীয় ছোট মাছের পোনা তৈরি করা হচ্ছে। গত ১২ বছরে চাষের মাধ্যমে দেশীয় প্রজাতির ছোট মাছের উৎপাদন চারগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।’
মন্তব্য