বাম্পার ফলন ও বেশি লাভের আশায় ঠাকুরগাঁওয়ের কৃষকরা ঝুঁকেছিলেন ভুট্টাচাষে। তবে দফায় দফায় কালবৈশাখী ও শিলাবৃষ্টিতে এ আশা এখন ক্ষীণ। প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভুট্টাক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। নুইয়ে পড়েছে হেক্টর হেক্টর পরিমাণ ভুট্টার প্রান্তর। এতে ফলনের পরিমাণ কমবে বলে আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। তবে দাম ভালো থাকায় ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার আশা এখনো জেগে আছে তাদের।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এবার ঠাকুরগাঁওয়ে ৫০ হাজার ৫৬৪ হেক্টর জমিতে ভুট্টার চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৪ লাখ ৩০ হাজার ৮৮৭ টন। মোট চাষকৃত জমির মধ্যে ‘রবি’ জাতের ভুট্টার চাষ হয়েছে ৩৩ হাজার ৬০ হেক্টর জমিতে। এখন পর্যন্ত রবি ভুট্টা কাটা হয়েছে সাত হাজার ৬৪৮ হেক্টর জমির। যা থেকে ৮১ হাজার ৮৩৪ টন ভুট্টা পাওয়া গেছে।
অন্যদিকে ১৭ হাজার ৫০৪ হেক্টর জমিতে গ্রীষ্মকালীন ভুট্টার চাষ হয়েছে। লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে এক লাখ ৬৫ হাজার ২৩৯ টন। তবে ঝড়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এ জাতের ভুট্টা।
কৃষি বিভাগ বলছে, ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে মোট দুই হাজার ৭৬০ হেক্টর জমির ভুট্টাক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে। তবে চূড়ান্ত ক্ষতির হিসেবে ৬৪২ হেক্টর জমি দেখানো হয়েছে।
এ দিকে নুইয়ে পড়া ক্ষেত থেকে ভুট্টা তুলতে বেড়েছে কৃষকের ব্যস্ততাÑ যেন সেই বিধ্বস্ত ভুট্টাক্ষেতেই রয়েছে লোকসানের শঙ্কায় কপালে ভাঁজ পড়া কৃষকের বেঁচে থাকার ‘অক্সিজেন’।
সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত জেলার বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে দেখা গেছে, নুইয়ে পড়া ডাঁটা থেকে ভুট্টার মচা ভাঙছেন কৃষিশ্রমিকরা। এ সময় কথা হয়েছে জেলার বিভিন্ন এলাকার ভুট্টাচাষিদের সঙ্গে। এর মধ্যে একজন সাইফুল ইসলাম।
সদর উপজেলার চিলারংয়ের কৃষক সইফুল ইসলাম বলেন, ‘সবশেষ কয়েক বছর ভুট্টার বাম্পার ফলন হচ্ছিল। যার ফলে অনেকে ভুট্টাচাষে ঝুঁকছিল। গত বছরের চেয়ে এবার আমাদের গ্রামের দ্বিগুণ জমিতে ভুট্টার চাষ করা হয়েছিল। এ বছরও দ্বিগুণ ফলন হতো। কিন্তু ঝড়ের কারণে বিঘাপ্রতি উৎপাদন অর্ধেকে নেমে এসেছে। তবে বাজাওে ভুট্টার দাম ভালো যাচ্ছে। তাই লোকসান কিছুটা পুষিয়ে নিতে পারব বলে প্রত্যাশা করছি। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ভুট্টা বিক্রি করতে চাই।’
বালিয়াডাঙ্গী উপজেলার কৃষক মিঠু রহমান। গত বছর তিনি চার বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেন। লাভ বেশি হওয়ায় এবার আট বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছেন তিনি। তবে ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে এবার তার অর্ধেকের বেশি ভুট্টাক্ষেতের ক্ষতি হয়েছে।
তিনি বলেন, ‘বারবার ঝড়ের কবলে না পড়লে এবার ভুট্টাচাষিরা অনেক বেশি লাভবান হতো। তবে বাজারে দাম ভালো। ক্ষতি কিছু কমিয়ে আনলেও লাভবান হতে পারব না।‘এবার মাঠেই কাচা ভুট্টা প্রতি কেজি ২৩-২৪ টাকায় বিক্রি করেছি। গতবারে বিক্রি করেছিলাম সর্বোচ্চ ১৪.৫০ টাকা। দাম থাকায় মাঠে দাঁড়িয়ে থাকা অবশিষ্ট ভুট্টার ক্ষেতটা আমার কাছে অক্সিজেন মনে হচ্ছে। দামে আমি খুশি।’একই উপজেলার কৃষক রমিজ উদ্দীন বলেন, ‘আবাদের অর্ধেক ভুট্টার ফসল ঝড়ে আক্রান্ত হয়েছে। গত বছর সাত বিঘা জমিতে ভুট্টার চাষ করেছিলাম। প্রতি বিঘাতে ৭০-৮০ মণ ভুট্টা পেতাম। কিন্তু এবারে ৪০ মণের বেশি পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।’
মুন্সিপাড়া গ্রামের কৃষক হাসেম আলী বলেন, ‘দফায় দফায় শিলাবৃষ্টির কারণে মচা হওয়ার আগেই ভুট্টার ডাঁটা ভেঙে গেছে। অনেকের আবার নুইয়ে পড়েছে। ফলন ভালো হয়নি। সে ক্ষেত্রে আমার মতো চাষিরা লোকসানে পড়বেন। উৎপাদন খরচ উঠে আসাও কষ্টসাধ্য হয়ে যাবে।’
জেলার ভুট্টা ব্যবসায়ী আখতার হোসেন বলেন, ‘এবার উৎপাদন ভালো হয়নি। মাঠ পর্যায়ে ভালো মানের দানাদার ভুট্টা মিলছে না। ঝড়ের জন্য যেসব ভুট্টা হেলে গেছে বা পড়ে গেছে, সেসব ভুট্টার দানা খুব একটা ভালো পাওয়া যাচ্ছে না। তবে দাম ভালো পাওয়ায় ওভাবেই দ্রুত ভুট্টা সংগ্রহ করছেন কৃষকরা।’
ঠাকুরগাঁও থেকে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ ট্রাক ভুট্টা জেলার বাইরে বিভিন্ন স্থানে যাচ্ছে বলে জানান এই ভুট্টা ব্যবসায়ী।
জেলা কৃষি কর্মকর্তা আবু হোসেন বলেন, ‘এবারে কয়েক দফায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টির জন্য ভুট্টাসহ অন্যান্য ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। যার কারণে উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হতে পারে। তবে এখনো যে পরিমাণ শস্য মাঠে আছে, তা থেকে উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য হতে পারে।’
মন্তব্য