লালমনিরহাটে যান্ত্রিক ত্রুটিযুক্ত, ফিটনেসবিহীন, অবৈধ কাগজপত্র ও রুট পারমিট ছাড়া যানবাহন অবাধে সড়কে চলাচল করছে। অভিযোগ উঠেছে ট্রাফিক পুলিশকে মাসিক চাঁদা দিয়ে ম্যানেজ করে চলছে এসব গাড়ি। যার কারণে বাড়ছে সড়ক দুর্ঘটনা। অভিযোগ আছে, আইন না মেনে সড়কে বেপরোয়াভাবে এসব অবৈধ যানবাহন চলাচল করলেও এ ব্যাপারে নীরব ভূমিকা পালন করছে লালমনিরহাট ট্রাফিক বিভাগ।
সরেজমিনে দেখা যায়, বুড়িমারী স্থলবন্দর থেকে প্রতিদিন শত শত পাথরবোঝাই ট্রাক লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কের ওপর দিয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে চলাচল করছে। এর মধ্যে যেসব ট্রাক প্রতিনিয়ত চলাচল করে তাদের অধিকাংশ ট্রাকের নেই সঠিক কাগজপত্র। এমনকি আইন না মেনে বেপরোয়াভাবে ওভার লোডিং ট্রাক চলাচল করছে এ মহাসড়ক দিয়ে।
শুধু তা-ই নয়, মাইক্রো স্ট্যান্ডের অর্ধশতাধিক গাড়ির নেই কোনো বৈধ কাগজপত্র। ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট বা টিআইকে মাসিক টাকা দিলেই সব অবৈধ কাগজপত্র হয়ে যায় বৈধ। সারাদেশের কোথাও আটক করা হয় না সে গাড়ি।
এছাড়া দিনের বেলায় শহরে এবং মহাসড়কে ইট-বালু বহনকারী ট্রাকটরগুলো চলাচল করছে কোনো ধরনের বাধা ছাড়াই। কারণ সেসব গাড়ির মালিকের কাছ থেকেও নেওয়া হয় মাসিক চাঁদা। ফলে ট্রাফিক পুলিশ শুধু পড়ে আছে মোটরসাইকেলের পেছনে।
সম্প্রতি ট্রাফিক ইন্সপেক্টর রফিকুল ইসলাম রংপুর থেকে নিয়মিত লালমনিরহাটে আসা সংবাদপত্র বহনকারী গাড়ি আটক করে প্রায় ঘণ্টাব্যাপী নানা হয়রানি করেন। বিষয়টি নিয়ে সাংবাদিকরা জানলে একপর্যায়ে সংবাদপত্রের গাড়িটি ছেড়ে দেওয়া হয়।
লালমনিরহাটের ট্রাফিক বিভাগের হয়রানির বিষয়ে পৌর শহরের বাসিন্দা মোটরসাইকেল চালক আবির হোসেন সজল বলেন, গাড়ির কাগজপত্র, হেলমেট, ড্রাইভিং লাইসেন্স ঠিক না থাকলে মামলা দিতেই পারে এটাই স্বাভাবিক।
‘কিন্তু কিছু দিন আগে একজন মুক্তিযোদ্ধার সন্তানকে বেলা ১১টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত থানায় বসিয়ে রেখে মামলা দিয়ে হয়রানির চেষ্টা করেন লালমনিরহাট সদর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর। পরে পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানার হস্তক্ষেপে মামলা তুলতে বাধ্য হন ওই ট্রাফিক ইন্সপেক্টর’, বলেন আবির হোসেন সজল।
পৌর এলাকার ওষুধের ব্যবসায়ী মোটরসাইকেল চালক রেজাউল হক বলেন, ‘ট্রাফিক পুলিশ প্রায় প্রতিদিনই অভিযান চালায়। কিন্তু সড়কে চলা বাস, ট্রাক, মাইক্রোবাস, ট্রাক্টরকে আটক করে না। রাস্তায় এত বাহন থাকলেও পুলিশের চোখ শুধু মোটরসাইকেলের ওপর।’
শহরের মাইক্রোবাস চালক বাবু বলেন, ‘আমার মাইক্রোর কাগজপত্র ঠিক নেই। তাই মাসিক কিছু টাকা এবং রিকুইজেশনে গাড়ি দিয়ে পুলিশকে ম্যানেজ করি। ফলে আমার গাড়ি নিয়ে কোথাও আর হয়রানি হতে হয় না।’
লালমনিরহাট সদর মাইক্রো স্ট্যান্ডের চালক হাবিল বলেন, ‘আমার আওতায় মোট পাঁচটি গাড়ি আছে। এরই মধ্যে একটি অ্যাম্বুলেন্স, একটি প্রাইভেট কার, একটি নোয়াহ, একটি সুপারজেল এবং একটি কেডিএস। তবে এর মধ্যে দুটি গাড়ির সমস্যা আছে। তাই মাসিক চাঁদা করে নিয়েছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘সার্জেন্টের মাধ্যমে মাসিক চাঁদা বাবদ দিতে হয় দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। আর ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) স্যারের কাছ থেকে কাগজ নিলে তিন হাজার টাকা পর্যন্ত দিতে হয়।’
গাইবান্ধার পলাশবাড়ী এলাকার ট্রাকচালক আশিকুর বলেন, ‘আগে প্রায়ই লালমনিরহাট-বুড়িমারী মহাসড়কে হয়রানি হতে হতো। একটি ফিলিং স্টেশন থেকে নিয়মিত তেল নেওয়ায় তারা পুলিশের সঙ্গে মাসিক চুক্তি করে দিয়েছে। এখন সড়কে হয়রানিমূলক যা কিছু হয় তার সব কিছু ওই ফিলিং স্টেশন দেখে।’
লালমনিরহাট ট্রাফিক ইন্সপেক্টর (টিআই) রফিকুল ইসলাম মুঠোফোনে বলেন, ‘টাকা নেওয়ার বিষয়ে কিছু অভিযোগ আছে, যা আমি অস্বীকার করব না। তবে অভিযোগ দিলেও বেশিরভাগ সময় অভিযোগকারীরা পরে আর মুখ খুলতে রাজি হন না। তারা নিজেরাই মীমাংসা করে নেন। ফলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সমস্যা হয়।’
তিনি বলেন, ‘ট্রাফিক বিভাগের কিছু সদস্যের বিরুদ্ধে তদন্ত চলছে। এর মধ্যে মোস্তাফিজুর নামে একজনকে সরানো হয়েছে। বাকিদের বিরুদ্ধেও ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’
আপনার বিরুদ্ধেও টাকা নেওয়ার অভিযোগ রয়েছে- এমন প্রশ্নে কোনো উত্তর না দিয়ে তিনি অন্য প্রসঙ্গে কথা বলতে বলেন।
এ বিষয়ে লালমনিরহাট পুলিশ সুপার আবিদা সুলতানার সঙ্গে মুঠোফোনে কথা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে তিনি মোবাইলে কথা বলতে রাজি নন। অফিসে আসলে বসে কথা বলা যাবে।
মন্তব্য