জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ায় প্রতি বছর সমুদ্র ভাঙনে কুয়াকাটার সি-বিচ এলাকার আয়তন ছোট হয়ে আসছে। তবে এ ভাঙন রোধে কাজের সঠিক তদারকি না থাকায় ও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের অনিয়মের কারণে সৌন্দর্য হারাচ্ছে সাগরকন্যা কুয়াকাটা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্যটকদের কথা ভেবে সি-বিচের সৌন্দর্য রক্ষা, পরিকল্পিতভাবে স্থায়ীভাবে ভাঙন রোধ ও রেবিবাঁধ তৈরিতে দরকার টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ। এ টেকসই উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে ফিরে আসবে কুয়াকাটার পুরোনো ঐতিহ্য ও সৌন্দর্যতা, পর্যটকরা পাবেন প্রশান্তি। এতে একদিকে বাড়বে স্থানীয় বিনিয়োগ; অন্যদিকে বাড়বে সরকারের রাজস্ব আদায়।
সরেজমিন দেখা গেছে, কুয়াকাটার সি-বিচ এলাকা রক্ষায় সমুদ্রের ভাঙন রোধে বিচ্ছিন্নভাবে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হয়েছে। এতে প্রায়ই ঘটছে ছোট-বড় দুর্ঘটনা। পড়ে গিয়ে অনেক পর্যটকদের হাত-পা মচকে যাচ্ছে। সরকারের উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা অনুযায়ী, দূর থেকে বালু এনে জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ভর্তি করে সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটার সি-বিচ এলাকায় ফেলার কথা। কিন্তু অনেক সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান সি-বিচ এলাকার বিভিন্ন জায়গায় গর্ত করে সেই বালু দিয়েই জিও টিউব ও জিও ব্যাগ ভর্তি করে ফেলছেন। ফলে খানাখন্দে ভরে গেছে সি-বিচ এলাকা। এমন পরিস্থিতি দেখে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন আগত একাধিক পর্যটকরা।
স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, বর্ষা মৌসুমে উত্তাল সমুদ্রের ঢেউ আছড়ে পড়ে সাগর পাড়ে। ফলে প্রতি বছর কুয়াকাটার সি-বিচ এলাকা ভেঙে লোকালয়ের দিকে আসছে। এ কারণে গত তিন বছর থেকে সমুদ্রের ভাঙন ঠেকাতে বালুভর্তি জিও ব্যাগ এবং জিও টিউব বসাচ্ছে পানি উন্নয়ন বোর্ড।
ভাঙন ঠেকাতে এ বছরও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কলাপাড়া ডিভিশন প্রায় ২ কোটি ৫৯ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি প্রকল্পের আওতায় সি-বিচ এলাকা প্রশস্তকরণে ২ কিলোমিটার এলাকায় আবারো জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে প্রায় ১৩০০ মিটার কাজ সম্পন্ন হলেও বাকি ৭০০ মিটার কাজ চলতি বছরের আগামী জুন মাসের মধ্যে শেষ হওয়ার কথা।
তবে এসব জিও ব্যাগ ও জিও টিউবের ভেতরের বালু চাঁদপুর ও যমুনার পাড় থেকে কিনে এনে কুয়াকাটাসংলগ্ন মহিপুর ফেলা হচ্ছে। সেখান থেকে আবার বিভিন্ন উপায় বালু সি-বিচ এলাকায় এনে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ১৪ হাজার ৩৮৪টি জিও ব্যাগ ও ছোট-বড় ১২৭টি জিও টিউব ভর্তি করে ফেলার কথা।
প্রকল্পে বালু কিনতে প্রায় ৭০ লাখ টাকা ধরা হলেও ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান অনেক সময় সি-বিচের বিভিন্ন জায়গায় গর্ত করে বালু উঠিয়ে সেই জিও ব্যাগ ভর্তি করে ফেলছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান কে কে এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকার মো. কবির হোসেন বলেন, ‘কাজ করার সময় কাজের সৌন্দর্য থাকে না। শেষ হলে বোঝা যায় মান কেমন।’
তিনি আরো বলেন, ‘সি-বিচ রক্ষা প্রকল্পের নিয়মানুযায়ী কাজ করছি। চাঁদপুর ও যমুনার পাড় থেকে বালু কিনে মহিপুর এনে বালু উত্তোলন করি। সেখান থেকে আবার ট্রাকে করে সি-বিচে ফেলে ড্রেজিং করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব লোডিং করতে হচ্ছে। এতে অনেক জায়গায় গর্র্ত হচ্ছে। তবে গর্ত থেকে বালু উঠিয়ে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব লোডিং করা হচ্ছে না।’
কুয়াকাটায় ঘুরতে আসা হানজালা বিন জাহাঙ্গীর জানান, কুয়াকাটা সমুদ্রসৈকত প্রতি বছরই ভাঙছে। এ ভাঙন প্রতিরোধের অজুহাতে এ ধরনের অপরিকল্পিত উন্নয়নে প্রতি বছর সরকারের যেমন কোটি কোটি টাকা অর্থ অপচয় হচ্ছে, তেমনি কুয়াকাটা জরাজীর্ণ সৈকতে পরিণত হচ্ছে। সামিয়া ইসলাম বুশরা দৈনিক নামে আরেক পর্যটক বলেন, কুয়াকাটায় এখন এসেই মন খারাপ হয়ে যায়। গত ১০ বছর আগের সৌন্দর্যের সি-বিচ এখন আর নেই। যে যার মতো করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন করে কুয়াকাটার ঐহিত্য হারাচ্ছে। পরিকল্পিত উন্নয়ন না করলে এর সৌন্দর্য ফিরিয়ে আনা সম্ভব নয়।'
পানি উন্নয়ন বোর্ডের পটুয়াখালী কলাপাড়ার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আরিফ হোসেন বলেন, ‘সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটাকে ঢেলে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। সে অনুযায়ী বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের কাজ চলমান।’
তিনি আরো বলেন, ‘সমুদ্রের ভাঙন থেকে সি-বিচ রক্ষায় গত তিন বছর ধরে পরীক্ষামূলক বিভিন্ন প্রকল্পের আওতায় বালুভর্তি জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা এবং বেড়িবাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। প্রথম দিকে বিচের সৌন্দর্যের কথা চিন্তা না করে এলোমেলো করে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে পরিকল্পিত অনুযায়ী, সি-বিচের সৌন্দর্যের কথা মাথায় রেখে জিও ব্যাগ ও জিও টিউব ফেলা হচ্ছে।’
আরিফ হোসেন বলেন, ‘ট্যুরিস্টদের কথা চিন্তা করে কুয়াকাটা বেইজ টেকসই উন্নয়ন করতে মার্চ মাসে ১২০০ কোটি টাকার একটি ডিপিএম তৈরি করে পরিপকল্পনা মন্ত্রণালয় পাঠানো হয়েছে।’
মন্তব্য