রাজশাহীর আমে ৯০১ কোটি টাকা ব্যবসার সম্ভাবনা

তারেক মাহমুদ, রাজশাহী ব্যুরো
রাজশাহীর আমে ৯০১ কোটি টাকা ব্যবসার সম্ভাবনা
আম প্রক্রিয়া করছে চাষি

বসন্তে বাগান ছিল মুকুলে ভর্তি, এরপর আসতে শুরু করে আমের গুটি। ঝরে পড়তে শুরু করে সে গুটিগুলোও।

আমচাষিদের কপালে পড়ে চিন্তার ভাঁজ। টানা বৃষ্টিহীনতায় ফলন নিয়ে চিন্তিত ছিলেন সবাই। তীব্র খরায় সেচ দিয়েও খুব একটা লাভ হচ্ছিল না।

আমের ফলন এসেছে গত বছরের তুলনায় অনেক কম। কিন্তু বেড়েছে আমবাগান। এর মধ্যেই শুরু হয়ে গেছে আম নামানো।

রাজশাহীতে এ মৌসুমে ১৮ হাজার ৫১৫ হেক্টর জমিতে এসেছে আম। গতবার ছিল ১৭ হাজার ৯৪৩ হেক্টর। গতবারের তুলনায় এবার বেড়েছে ৫৭২ হেক্টর জমি।

এ জমি থেকে এবার দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ টন আম উৎপাদনের আশা করা হচ্ছে, যা হেক্টর প্রতি গড় উৎপাদন ১১.৬০ টন।

কেজি প্রতি এবার আমের গড় দাম ধরা হয়েছে ৪২ টাকা। সে হিসাবে এবার ৯০১ কোটি টাকার আমের বেঁচাকেনা হবে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, গত মৌসুমে আমের উৎপাদন বেশি হলেও করোনার কারণে আমচাষিরা দাম পায়নি।

গেল মৌসুমে আম উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ১৭ হাজার ১২৮ টন। গড় দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ৪০ টাকা কেজি।

সে হিসাবে ৮০৬ কোটি ৯ লাখ ৯৩ হাজার টাকার ব্যবসা হয়েছে।

আর এ বছর তুলনামূলক বেশি জমিতে আমের চাষ হলেও আমের উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে দুই লাখ ১৪ হাজার ৬৭৬ টন, যা টাকার হিসাবে প্রায় ৯০০ কোটি টাকা। গতবারের তুলনায় এবার ১০০ কোটি বেশি।কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, রাজশাহী জেলার নয়টি উপজেলা ও মহানগরীর দুটি থানা এলাকায় আমের চাষ হয়।

তবে সবচেয়ে বেশি আম উৎপাদন হয় জেলার বাঘা উপজেলায়। এবার বাঘায় আট হাজার ৫৭০ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হয়েছে।

এই উপজেলা থেকেই ৯৬ হাজার ৮৪১ টন আম উৎপাদন হবে।

এ ছাড়া জেলার চারঘাটে তিন হাজার ৮৮৫ হেক্টর জমিতে ৪৪ হাজার ২৮৪ টন, পুঠিয়ায় এক হাজার ৫৩০ হেক্টর জমিতে ১৮ হাজার ৫১৩ টন, গোদাগাড়ীতে এক হাজার ২২০ হেক্টর জমিতে ১৪ হাজার ৮২৩ টন, পবায় ৯২০ হেক্টর জমিতে ১১ হাজার ১৭৮ টন, দুর্গাপুরে ৮৫০ হেক্টর জমিতে ১০ হাজার ৩৭০ টন, বাগমারায় ৫৬৫ হেক্টর জমিতে ছয় হাজার ৮৬৪.৭৫ টন, মোহনপুরে ৪০৭ হেক্টর জমিতে চার হাজার ৯৫৩.১৯ টন, তানোরে ৩৬০ হেক্টর জমিতে চার হাজার ৩২৬ টন, মহানগরের মতিহারে ১৩৫ হেক্টর জমিতে এক হাজার ৬৪১ টন এবং বোয়ালিয়া থানা এলাকায় ৭৩ হেক্টর জমিতে ৮৮৩.৩০ টন আম উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে।

অধিদপ্তর থেকে জানানো হয়, উপজেলা পর্যায়ে গড়ে হেক্টর প্রতি আমের গড় উৎপাদন ধরা হয়েছে ১১.৬০ টন। আর মহানগরীতে ধরা হয়েছে ১২.১৭ টন।

রাজশাহীতে শুরু হয়ে গেছে আম নামানো। গত শুক্রবার থেকে গুটিজাতের আম নামানো শুরু করে।

বিভিন্ন জাতের আম পাড়ার সম্ভাব্য তারিখ নির্ধারণ করে দিয়েছেন জেলা প্রশাসন।

জেলা প্রশাসক (ভারপ্রাপ্ত) মুহাম্মদ শরিফুল হক বলেন, শুক্রবার থেকে গুটিজাতের আম নামানো শুরু হয়েছে।

এ ছাড়া গোপালভোগ ২০ মে, লক্ষণভোগ, ২৫ মে, রাণীপছন্দ ২৫ মে, হিমসাগর ২৮ মে, ল্যাংড়া ৬ জুন, আম্রপালি ও ফজলি ১৫ জুন, আশ্বিনা ও বারি ফোর ১০ জুলাই, গৌড়মতি ১৫ জুলাই এবং ইলামতি জাতের আম ২০ আগস্ট নামানোর তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে।

তিনি বলেন, ‘বেঁধে দেওয়া তারিখের আগে কোনো আমচাষি আম নামালে প্রয়োজনীয় আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

ফরমালিনমুক্ত আম যাতে বাজারজাত নিশ্চিত হয় এজন্য জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ টিম সব সময় মনিটরিং করবে।’

রাজশাহীর বাগান মালিক আরেজ আলী বলেন, ‘এবার ১০ বিঘা জমির আমবাগানের প্রায় দুই শতাধিক গাছে আম ধরেছে।

গতবছর ফলন ভালো হলেও লকডাউনের কারণে আমের দাম পাওয়া যায়নি। তবে এবার ফলন কম হলেও আমের ভালো দাম পাওয়া যাবে বলে আশা করছি।’

উত্তরবঙ্গের সবচেয়ে বড় আমের আড়ৎ বানেশ্বর বাজার। এখানে রয়েছে প্রায় শ’ খানেক আমের আড়ৎ।

মাকসুদুল আলম নামের এক আড়ৎদার বলেন, ‘গত বছর করোনার কারণে ব্যবসায় খুব বেশি সফলতা পাইনি।

কিছুটা লোকসানও হয়েছে। এবার হয়তো আমের ব্যবসায় গতবছরের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবো।’

রাজশাহীর ফল গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ড. আলীম উদ্দীন বলেন, ‘সামগ্রিক অর্থে এবার আম বাগানের পরিধি বেড়েছে, ফলে এ মৌসুমে ফলন কম হলেও লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে।

এ ছাড়া এবার ঝড়-বৃষ্টির এখন ওইভাবে না হওয়ায় আমের গুটিও কম ঝড়েছে।’

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাগ্রোনমি অ্যান্ড এগ্রিকালচারাল এক্সটেনশন বিভাগের অধ্যাপক ড. গিয়াস উদ্দিন আহমদ বলেন, ‘প্রাকৃতিকভাবেই চলতি মৌসুম আমের জন্য অফ সিজিন।

স্বভাবতই কোনো বছর আমের বাম্পার ফলন হলে পরের বছর গাছে আম কিছুটা কম আসে। এবারও তা-ই হয়েছে।’

রাজশাহী কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফরের উপপরিচালক মোজদার হোসেন বলেন, ‘জেলা প্রশাসন থেকে আম নামানোর সময়সীমা নির্ধারণ করে দিয়েছেন।

গত বছরের চেয়ে এবার ৫৭২ হেক্টর বেশি জমিতে আমের আবাদ হয়েছে। তবে ফলন কম হওয়ায় গত বছরের চেয়ে চলতি মৌসুমে দুই হাজার ৪৫২ টন আম কম উৎপাদন হতে পারে।

তবে গত বছরের চেয়ে এবার আমের দাম চড়া যাবে। সেই দিক বিবেচনায়, আমচাষিরা বেশ লাভবান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।’

মন্তব্য