-->
শিরোনাম

বিলীনের পথে অভয়নগরের ১১ শিবমন্দির

যশোর ব্যুরো
বিলীনের পথে অভয়নগরের ১১ শিবমন্দির

অযত্ন-অবহেলা আর রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে বিলীন হয়ে যেতে বসেছে প্রায় ৩শ বছরের পুরানো যশোরের অভয়নগরে ১১টি শিবমন্দির।

এক সময় যেখানে নিয়মিত পূজা-অর্চনা হতো, এখন সেটি সাপ-পোকামাকড়ের বাসস্থান। দেশের অনন্য স্থাপনা অভয়নগরের ১১ শিবমন্দির রক্ষা করতে পারলে তা হবে এই অঞ্চলের একটি অন্যতম পর্যটনকেন্দ্র বলে আশা সচেতন মহলের।

ভৈরব নদের উত্তর পারে মনোরম পরিবেশে অবস্থিত অবস্থিত এই ১১টি শিবমন্দির। এর বেশকিছু জমি ইতোমধ্যে বেহাত হয়ে গেছে। চুরি আর লুটপাট হয়েছে মন্দিরের প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন শিবলিঙ্গসহ মূল্যবান বহু মালামাল। ধসে পড়ছে ইট-সুরকিও।

ইতিহাস বলে, ১৭৪৫ থেকে ১৭৬৪ সালের মধ্যে যশোরের চাঁচড়ার রাজা নীলকণ্ঠ রায় এই ১১টি শিবমন্দির প্রতিষ্ঠা করেন। সেই হিসেবে মন্দিরগুলোর বয়স ৩শ বছরের বেশি। চাঁচড়ায় রাজধানী হলেও খুলনাসহ সুন্দরবনের বিশাল অংশ শাসন করার জন্য রাজা নীলকণ্ঠ রায় বসবাসের জন্য অভয়নগরের ভৈরব পারের মনোরম পরিবেশে একটি রাজবাড়ি নির্মাণ করেন।

সতীশ চন্দ্র মিত্রের লেখা যশোর-খুলনার ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, যশোরের রাজা প্রতাপাদিত্যের পরবর্তী প্রজন্মের রাজা নীলকণ্ঠের অতি আদরের এক মেয়ের নাম ছিল অভয়া। রাজা নীলকণ্ঠ তার মেয়ে অভয়াকে নড়াইলের জমিদারপুত্র নীলাম্বর রায়ের সঙ্গে বিয়ে দেন। মহা ধুমধামে অভয়নগরের রাজবাড়িতেই অনুষ্ঠিত হয় অভয়া দেবীর বিয়ে ও বিয়ে-উত্তর ভোজন।

বিয়ের কয়েকদিনের মধ্যে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন স্বামী নীলাম্বর। ফলে অল্প বয়সেই বিধবা হন অভয়া দেবী। তখন হিন্দু ধর্মে দ্বিতীয় বিয়ের কোনো বিধান না থাকায় রাজকন্যা বাকি জীবন শিবের পূজা-অর্চনা করে কাটানোর অভিপ্রায় ব্যক্ত করলে পিতা নীলকণ্ঠ রায় অভয়নগরের জমিদারবাড়ির পাশে মেয়ের জন্য ১১টি শিবমন্দির নির্মাণ করে দেন।

আধুনিক শিল্প স্থাপত্যের এক অপূর্ব নিদর্শন এই শিবমন্দিরকে কেন্দ্র করে রাজা নীলকন্ঠ রায় এখানে একটি নগরীও স্থাপন করেন। রাজকন্যা অভয়ার নামানুসারে সেই নগরীর নাম দেওয়া হয় অভয়নগর। রাজকন্যা আর ১১টি শিবমন্দিরের নিরাপত্তা আর রক্ষণাবেক্ষণে এখানে জমিদার নিজস্ব নিরাপত্তাকর্মীও নিয়োগ করেন। ১১টি শিবমন্দিরে প্রতিষ্ঠা করেন ১১টি কষ্টিপাথরের শিবলিঙ্গ। এ ছাড়া বিভিন্ন প্রকারের দেব-দেবীর জন্য পৃথক মন্দিরও স্থাপন করেন রাজা নীলকণ্ঠ রায়। কথিত আছে, কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরালয় খুলনার ফুলতলার জমিদারদের সঙ্গে এই অভয়নগরের অভয়া দেবী ও তার শ^শুরকুলের আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিল।

অভয়া রানীর মৃত্যু আর রাজপ্রথার বিলুপ্তির কারণে নির্জন শ্মশানে পরিণত হয় অভয়নগর। ব্রিটিশ শাসনামলের শেষদিকে আবারো অভয়নগরকে জাগ্রত করতে এই ১১ শিবমন্দিরকে ঘিরে নেওয়া হয় নানা উদ্যোগ। দেশ বিভাগের পর এই অঞ্চলের সনাতন ধর্মাবলম্বীরা দলে দলে দেশ ত্যাগ করলে জৌলুস হারায় অভয়নগর আর ১১ শিবমন্দির। একপর্যায়ে অভয়নগর থেকে সবকিছু স্থানান্তর করা হয় আজকের নওয়াপাড়া শহরে।

ফলে পেছনে নদীর উত্তর প্রান্তে পড়ে থাকে অভয়া দেবীর স্মৃতিবিজড়িত ১১ শিবমন্দিরসহ বিশাল জমিদারবাড়ি। কালে কালে সেই জমিদারবাড়িটি বিলীন হয়েছে দখলদারিত্ব আর লুটপাটের স্রোতে। এখন পড়ে আছে তার ধ্বংসাবশেষ। এত কিছুর পরও ঝোপ-জঙ্গলের মধ্যে মাথা তুলে দাঁড়িয়ে আছে ১১টি নান্দনিক নির্মাণশৈলীর শিবমন্দিরগুলো। ১০টি পরিত্যক্ত।

আর একটিকে কোনোক্রমে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করে স্থানীয়রা নিত্য পূজা-অর্চনা করেন। প্রতি বছর চৈত্রসংক্রান্তিতে এখানে এখনো বসে মেলা আর পূজা-পার্বণ। দূর-দূরান্ত থেকে এখনো ভক্তবৃন্দের পদচারণায় মুখরিত হয় অভয়া দেবীর ১১ শিবমিন্দর প্রাঙ্গণ। অতিথিরা কিছু সময়ের জন্যে হলেও হারিয়ে যান ইতিহাসের অতলে।

মন্তব্য

Beta version