বাজারে অপরিপক্ব লিচু, রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

বিজন কুমার দাস, দিনাজপুর
বাজারে অপরিপক্ব লিচু, রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি

মধু মাসের ঊষালগ্নে লিচুর রাজ্য দিনাজপুরের বিভিন্ন বাজারে আমদানি হতে শুরু করেছে লিচু। তবে অধিকাংশ লিচুই অপরিপক্ব। এসব লিচু খাদ্য হিসেবে গ্রহণে রয়েছে মারাত্মক স্বাস্থ্যঝুঁকি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, একটু বেশি লাভের আশায় বাগানীরা এসব লিচু বাজারে বিক্রি করছেন। আর এসব লিচু খেলে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রকমের রোগের সংক্রমণ হতে পারে বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের।

দিনাজপুর জেলায় চলতি বছর ৫ হাজার ৪৮১ হেক্টর জমিতে লিচুর চাষ করা হয়েছে। আর ফলনের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ২৯ হাজার মেট্রিক টন। ছোট বড় মিলিয়ে এই জেলায় লিচু বাগানীর সংখ্যা প্রায় ৭০০ জন। জেলায় লিচুর মধ্যে রয়েছে মাদ্রাজী, বোম্বাই, বেদেনা, চায়না থ্রি ও কাঁঠালী জাতের লিচু। প্রকারভেদে এসব লিচু পর্যায়েক্রমে বাজারে আমদানি হতে শুরু করে।

মে মাসের শেষে বাজারে আমদানি হয় মাদ্রাজী জাতের লিচু। এরপর একে একে এপ্রিলে শেষে (আনুমানিক ২০ এপ্রিল) বোম্বাই, জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (আনুমানিক ১০ জুন) বেদেনা, সবশেষে চায়না থ্রি ও কাঁঠালী জাতের লিচু উঠতে শুরু করে। কৃষি সম্প্রসারণের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, বাজারে আগাম এই লিচুটি মাদ্রাজী জাতের।

জেলা শহরের বাহাদুর বাজার এলাকা ঘুরে দেখা যায়, এক ফল বিক্রেতা মাদ্রাজী জাতের লিচু বিক্রি করছেন। তার লিচুর অধিকাংশই কাঁচা। যা পরিপূর্ণভাবে পাকতে আরো প্রয়োজন ১০ থেকে ১২ দিন। প্রতি ১০০ লিচু তিনি বিক্রি করছেন ১৬০ থেকে ২২০ টাকা দরে।

বাহাদুর বাজারে মাদ্রাজী লিচু বিক্রি করছেন এক বিক্রেতা

ফল বিক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাগান মালিকরা অতিরিক্ত লাভের আশায় আগাম এসব লিচু বিক্রি করছেন। আর ক্রেতারা বলছেন, লিচুর রাজ্যে প্রথম আমদানি হওয়ায় উৎসাহী হয়ে তারা অপরিপক্ব লিচু কিনছেন। তবে উৎসাহী হলেও দ্বিমত পোষণ করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, এসব অপরিপক্ব লিচু খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করলে ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন রকমের রোগের সংক্রমণ হতে পারে।

জানা যায়, ২০১৫ সালে অতিরিক্ত কীটনাশক দেওয়া অপরিপক্ব লিচু খেয়ে বীরগঞ্জ উপজেলায় চারজন, বিরল উপজেলায় তিনজন, খানসামা উপজেলায় একজন, চিরিরবন্দর উপজেলা একজন, কাহারোল উপজেলায় একজন এবং পার্বতীপুরে একজন নিয়ে সর্বমোট জেলায় ১১ জনের মৃত্যু হয়।

এর আগে ২০১২ সালের ৬ জুন থেকে ২০ জুন পর্যন্ত দিনাজপুর জেলায় ১২টি শিশুর মৃত্যু হয়।

এরপর ২০১৭ সালের ২৪ জুলাই ‘আমেরিকান জার্নাল অব ট্রপিক্যাল মেডিসিন অ্যান্ড হাইজিন’ এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়, সে সময়ে চাষিরা অতিরিক্ত মাত্রায় বিষাক্ত কীটনাশক এনডোসালফেন ব্যবহার করেছিল। লিচুতে ব্যবহৃত ওই বিষ শিশুদের পেটে গিয়ে তাদের মৃত্যু হয়েছে।

বিরল উপজেলার বহলা গ্রামের বাসিন্দা জাহাঙ্গীর আলম জানান, তিনি আজ বাজারে এসে দেখেন লিচু উঠেছে। নতুন ফল, নিলে বাড়ির লোকজন খাবে। দর চাইল ২২০ টাকা শ (১০০ পিস)। তবে দামটা তার কাছে তেমন কিছু নয়। এই ফল নতুন বাজারে উঠছে, তিনি ৩০০ টাকা শ হলেও কিনতেন।

জেলার দশমাইল এলাকার শঙ্কর চন্দ্র রায় জানান, তিনি ঢাকায় চাকরি করেন। ছুটিতে বাড়িতে এসেছেন। ট্রেন থেকে নেমে বাচ্চাদের জন্য ফল কিনতে বাজারে এসে দেখেন লিচু উঠেছে। নতুন ফল তাই কিনেছেন, বাচ্চারা খাবে। এখনো লিচুগুলো ভালোভাবে পাকেনি। নতুন ফল হিসেবে নেওয়া।

ফল বিক্রেতা ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি ১০ বছর ধরে ফলের ব্যবসায় করে আসছি। এখনো পরিপূর্ণ লিচু হয়নি। আমি এই লিচু আড়ত থেকে কিনে এনেছি ১৬০ টাকা দর হিসেবে (১০০ পিস)। লিচু বিক্রি করছি ২০০ থেকে ২২০ টাকায়। আর এক সপ্তাহ পর আরো লিচু আসতে পারে।

দিনাজপুরের সিভিল সার্জন ডা. মো. এএইচএম বোরহান-উল-ইসলাম সিদ্দিকী বলেন, ‘লিচুগাছে অরগানো ফসফরাস কোম্পাউন্ট নামে এক ধরনের কীটনাশক স্প্রে করে থাকেন লিচুচাষিরা। এই কীটনাশক প্রয়োগের নির্ধারিত সময়ের আগে এসব লিচু খেলে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। অপরিপক্ব এসব লিচু না খাওয়াই ভালো। এই লিচু খালি পেটে খেলে তীব্র গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হয়।’

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (শস্য) মো. খালেদুর রহমান বলেন, ‘বর্তমানে দিনাজপুরে লিচু ভাঙার সময় আসেনি। কিন্তু কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা অপরিপক্ব লিচু বাজারে বিক্রি শুরু করেছেন। দিনাজপুরের লিচু জেলার বাইওে, এমনকি বাইরের দেশেও পাঠানো হয়।’ তাই পরিপক্ব হওয়ার পর বাজারে লিচু আনার পরামর্শ দেন তিনি।

জাতীয় ভোক্তা সংরক্ষণ অধিদপ্তর দিনাজপুরের সহকারী পরিচালক মমতাজ বেগম বলেন, ‘কয়েকদিনের মধ্যে দিনাজপুরের লিচু নিয়ে জেলা প্রশাসক কার্যালয়ে একটা মিটিং অনুষ্ঠিত হবে। সেই মিটিংয়ে লিচু নিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হবে। বর্তমানে এখন লিচু বাজারে উঠানোর সময় হয়নি। এক্ষেত্রে ভোক্তাদেরও সচেতন হতে হবে।’

 

মন্তব্য