এক বুক আশায় বোরোর আবাদ করেছিল নীলফামারীর কৃষকেরা। ধানও হয়েছিল ভালো। তবে বাম্পার ফলনেও তাদের আনন্দ ম্লান হয়ে গেছে। এর মূলে রয়েছে ঝড়বৃষ্টি ও শ্রমিক সংকট।
গত এপ্রিল ও চলতি মাসের শুরু থেকে দফায় দফায় জেলাটিতে ঝড়বৃষ্টি হয়। এতে পানির নিচে চলে যায় সোনালি ধান। এর মধ্যে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রমিক সংকট। ক্ষেতে পানি থাকায় শ্রমিকরা পানিতে নেমে ধান কাটতে অনীহা দেখাচ্ছেন। এতে বিপাকে পড়েছেন জেলার কৃষকরা।
কৃষকরা জানান, জেলার ছয় উপজেলায় বোরো ধান কাটা-মাড়াই শুরু হয়েছে। তবে বৃষ্টিতে বোরোক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। একই সঙ্গে ঝড়ে নুয়ে পড়েছে ধানগাছ। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে শ্রমিক সংকট। পানি থাকায় ধান কাটতে অনীহা তাদের। বাম্পার ফলনে লাভ তো দূরের কথা, উৎপাদন খরচও তোলা নিয়ে টানাটানিতে পড়েছেন কৃষকরা।
এ দিকে বর্তমানে প্রতি মণ ধান ৮৫০ টাকায় বিক্রি করছেন কৃষকরা। এতে উৎপাদন খরচও উঠছে না বলে জানিয়েছেন তারা। সব মিলিয়ে শঙ্কা ও চিন্তার ভাঁজ তাদের কপালে। শ্রমিক সংকটে অনেকে বাধ্য হয়ে পরিবারের লোকজন নিয়ে কাটছেন ধান। অনেকে আবার বাড়তি পারিশ্রমিক দিয়ে ধান কেটে ঘওে তুলছেন। এতে উৎপাদন খরচ বেড়ে লোকসান হবে বলে জানিয়েছেন কৃষকরা।
সরেজমিন জেলা সদর, ডোমার ডিমলা, কিশোরগঞ্জ ও সৈয়দপুর উপজেলার বিভিন্ন গ্রামের ফসলের মাঠ ঘুরে দেখা যায়, নিচু জমির ৯০ শতাংশ পাকা ধানক্ষেত পানিতে তলিয়ে গেছে। ধান পাকলেও শ্রমিক সংকটের কারণে বেশির ভাগ জমির ধান এখনো কাটতে পারেননি কৃষকরা।
নীলফামারী সদর উপজেলার ইটাখোলা ইউনিয়নের পাঁচমাথা এলাকার রশিদুল ইসলাম ১০ বিঘা জমিতে বোরো আবাদ করেছেন। তিনি বলেন, ‘চারা রোপণ, আগাছা পরিষ্কার, কীটনাশক, সেচ, কর্তন, পরিবহণ, মাড়াইসহ বিঘাপ্রতি ১৫ হাজার টাকারও বেশি খরচ হয়েছে। বিঘায় ২০-২২ মণ ধান হবে। এখন বাজার ধানের যে দাম তাতে লোকসানে পড়তে হবে।
‘ধান কাটার শ্রমিক পাচ্ছি না। এমনিতে ধান কাটতে বিঘাপ্রতি তিন সাড়ে তিন হাজার টাকা নেয় শ্রমিকরা। তবে বৃষ্টির পানিতে ক্ষেত তলিয়ে যাওয়ায় ছয় হাজার টাকায়ও শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না।’
একই এলাকায় লক্ষ্মীচাপ ইউনিয়নের কাছারি বাজার এলাকার কৃষক শরৎ রায় দুই বিঘা জমিতে বোরোর আবাদ করেছেন। বৃষ্টির পানিতে ক্ষেত তলিয়ে গেছে তার।
তিনি বলেন, ‘পানিতে জমির ধান ডুবে গেছে। আরো দুদিন রাখলে এ ধান নেওয়া যাবে না। যেখানে আরো দশদিন পর ধান কাটা শুরু করতাম পানি জমে থাকায় আগে কেটে নিতে হচ্ছে। লাভের আশা আর নাই, খরচটা উঠলেও বাঁচি।’
একই অবস্থা চওড়া বড়গাছা ইউনিয়নের দক্ষিণ চওড়া গ্রামের কৃষক সুমন ইসলামের। তিনি আবাদ করেছেন ২০ বিঘা জমিতে। তিনি বলেন, ‘ধান ক্ষেতে হাঁটু পানি। শ্রমিকও পাওয়া যাচ্ছে না। বেশি টাকা পাওয়ায় এই এলাকার শ্রমিকরা দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যায়। যে কারণে আমাদের এখানে শ্রমিক সংকট দেখা দেয়।’
দক্ষিণ কানিয়াল খাতা গ্রামের গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে পানিতে নেমে ধান কাটছেন ছয়জন শ্রমিক। দেড় বিঘা জমির ধান কাটতে তারা নিচ্ছেন ছয় হাজার টাকা। তিনি বলেন, ‘শ্রমিক নেই এলাকায়। টাঙ্গাইল, নওগাঁ, কুমিল্লাসহ বিভিন্ন এলাকায় গেছে ধান কাটতে। ওদিকে গেলে বেশি মজুরি পাওয়ায় সবাই চলে যায়।’
কিশোরগঞ্জ উপজেলার কৃষক আলেনূর রহমান বলেন, ‘প্রতিবিঘা জমির ধান কাটতে সাড়ে ৫ থেকে ৬ হাজার টাকা শ্রমিকদের দিতে হচ্ছে। দুপুরের খাবারও দিতে হচ্ছে। আর মেশিনে ধান মাড়াইয়ের জন্য দিতে হচ্ছে বিঘাপ্রতি ৮০০ টাকা।’
ধান কাটা শ্রমিকদের সর্দার জয়নাল বলেন, ‘আমার দলে ১০ জন শ্রমিক আছেন। এনজিওর কিস্তি ও সংসারের অভাব-অনটনের কারণে প্রতিবিঘা ধান কাটার জন্য সাড়ে ৫ হাজার করে টাকা নেওয়া হচ্ছে। আমরা শুধু কেটে কৃষকের উঠানে আনব। আমরা যারা এলাকায় কাজ করি সবাই কয়েকজন মিলে দল করে ধান কাটতেছি। ধানক্ষেতে কোমর পরিমাণ পানি।’
সদরের ঢেলাপীর হাটে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিমণ বোরো ধান বিক্রি হচ্ছে ৮০০- ৮৫০ টাকা দরে। দূর-দূরান্ত থেকে আসা পাইকাররা ধান কিনে বস্তাবন্দি করছেন। পরে ট্রাকে করে সেগুলো নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
জেলা সদরের উপ-সহকারী কৃষি কর্মকর্তা রাকিব আবেদীন হিরু বলেন, ‘ঝড়বৃষ্টির পূর্বাভাস আমরা আগেই পেয়েছিলাম। সে রকম তথ্যও আমরা কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছি। যেসব ক্ষেতের ধান ৮০ ভাগ কাটার উপযুক্ত হয়েছে সেগুলো কর্তনের পরামর্শ দিয়েছি। বৃষ্টির কারণে কোনো কোনো এলাকায় ধান কাটা শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে। এক্ষেত্রে আমরা কৃষকদের আধুনিক কৃষি যন্ত্রপাতি ব্যবহারের জন্য উদ্বুদ্ধ করছি।’
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, এ বছর জেলার ছয় উপজেলায় ৮২ হাজার ৬৭০ হেক্টর জমিতে বোরোর আবাদ করা হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৩ লাখ ৬৫ হাজার ২৬৪ টন।
মন্তব্য