-->
শিরোনাম

অবসর সময়েও ব্যস্ত হাওরাঞ্চলের কৃষাণীরা

পুলক পুরকায়স্থ, মৌলভীবাজার
অবসর সময়েও ব্যস্ত হাওরাঞ্চলের কৃষাণীরা
মৌলভীবাজারের কাওয়াদীঘি এলাকার কাদিপুর গ্রামে ধান গাছের বিশেষ ঝাড়ু তৈরিতে ব্যস্ত কৃষাণীরা

হাওরাঞ্চলে বোরো ফসল ঘরে তোলার শেষ সময় এখন। প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে থাকা হাওরপাড়ের মানুষ বোরো ফসল থেকে সারা বছর সংসার চালানোর জোগান করেন। তেমনি কৃষাণীদের তৈরি করা পাকা ধান গাছের বিশেষ ঝাড়ু দিয়ে সারা বছর চালিয়ে নেন তারা।

শহর বা গ্রামের বাজার থেকে মধ্যমানের একটি ফুলঝাড়ু কিনতে আশি থেকে একশ’ টাকার প্রয়োজন। এগুলো দুই থেকে তিন মাস ব্যবহার করা যায়। এর বিপরীতে অর্থ সাশ্রয় করতে হাওরাঞ্চলের শত শত কৃষাণীকে দেখা যায় পাকা ধান গাছের বিশেষ ঝাড়ু তৈরি করতে। অবসর সময়েও ব্যস্ততা থাকে তাদের।

জানা গেছে, কাজের ফাঁকে অবসরের সময়টুকুতে তারা এ ঝাড়ু তৈরি করেন। এক গোছা পাকা ধানগাছ থেকে ধান ঝড়িয়ে ছোট দড়ি দিয়ে বেঁধে তৈরি হয় এগুলো। একটা ঝাড়ু এক মাস যায়, এ হিসাবে প্রত্যেকে ১২ থেকে ১৫টা ঝাড়ু তৈরি করেন এক বছরের জন্য। কারণ বোরো মৌসুম ছাড়া অন্য সময়ে হাওরে আর ধান পাওয়া যায় না। তাই প্রতিবছরই কৃষাণীরা একবছরের জন্য এগুলো তৈরি করেন।

মৌলভীবাজারের কাওয়াদীঘি হাওরাঞ্চল ঘুরে দেখা যায়, এলাকার প্রত্যন্ত হাওরাঞ্চলের কৃষাণীরা ধান ঘরে তোলার পাশাপাশি এখন ব্যস্ত পাকা ধান গাছের খড়ের ঝাড়ু তৈরিতে। এই এলাকার শত শত কৃষক পরিবারের নারীরা, নিজেদের গৃহস্থালি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য খড়ের ঝাড়ু তৈরি করছেন। দুপুরে খাওয়া দাওয়া শেষে অবসরের সময়টুকু তারা কাজে লাগান ঝাড়ু তৈরিতে।

সরেজমিনে কাওয়াদীঘি এলাকার কাদিপুর গ্রামে বিকেলে গিয়ে দেখা যায়, কৃষাণীরা এই গ্রামের বেশ কয়েকটি উঠোনে ও রাস্তার পাশে বসে খড়ের ঝাড়ু তৈরির কাজ করছেন। এই ঝাড়ু দিয়ে ঘরের ভেতর মাটির মেঝে ঝাড়ু দেওয়া হয়। গৃহস্থালি পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার জন্য ধান গাছের এই তৈরি খড়ের ঝাড়ুই চলে যায় তাদের সারা বছর।

কয়েকজন কৃষাণীর সঙ্গে আলাপকালে জানা যায়, বাড়ির পুরুষরা হাওর থেকে বোরো ধান কেটে বাড়িতে নিয়ে এলে সেখান থেকে শক্ত ও তুলনামূলক মোটা সাইজের খড় প্রথমে একটা একটা করে আলাদা করা হয়। তারপর ঘণ্টা দুয়েক রোদে শুকানো হয় ধান সমেত খড়গুলোকে। তারপর বিকেলে পরিবারের কিংবা পাশের বাড়ির কয়েকজন মিলেমিশে তৈরি করেন খড়ের ঝাড়ু।

কাদিপুর গ্রামের রাইমনি সরকার জানান, এখন বোরো ধান কাটার মৌসুম চলছে। আমাদের এখানে প্রায় প্রতিটি পরিবারই ধান কাটা ও তোলার সঙ্গে যুক্ত। তাই এখানকার অনেকেই খড়ের ঝাড়ু তৈরি করেন। প্রথমে ধান সমেত কাটা গাছগুলো থেকে ধান ছাড়ানো হয়। এজন্য একমুঠো কাটা ধানগাছ হাতে নিয়ে শক্ত মাটিতে বেশ কয়েকবার আঘাত করতে হয়। এভাবেই ধান ঝরে পড়ে। অনেক সময় হাত দিয়েও ছাড়াতে হয়।

আরেক কৃষাণী বিনতা রানি সরকার বলেন, ‘বিকেলের অবসর সময়ে আমরা কয়েকজন পাড়া প্রতিবেশী মিলে গল্প করি, পাশাপাশি ঝাড়ু তৈরি করি। আমরা ঘণ্টা দুয়েক সময়ে একজন সাত থেকে আটটি ঝাড়ু তৈরি করতে পারি। ছোট-বড় ২৫ থেকে ৩০টি খড় দিয়ে একটি আঁটি তৈরি করে পাটের সুতলি দিয়ে বাঁধা হয়। আরো দুই-তিন দিন লাগবে শেষ হতে।’

এক একটি খড়ের ঝাড়ু গৃহস্থালি কাজে ২০ থেকে ২৫ দিন ব্যবহার করা যায় বলে জানান সুমতি রানি সরকার। তিনি বলেন, ‘আমি ২৫টার মতো ঝাড়ু বানাইমু। দুই দিনে তেরোটা বানাইছি।’

হাওর থেকে গরু নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন কৃষক মুকুন্দ দাশ। তিনি বলেন, ‘আমরা গরিব মানুষ সব সময় কাজের মধ্যে থাকতে হয়। এখানে পুরুষ মহিলা বিষয় না। যখন যে ফ্রি থাকে, কাজের ফাঁকে ফাঁকে পরিবারের নানাবিধ কাজ করা হয়ে থাকে।’

জেলা পরিবেশ সাংবাদিক ফোরামের সভাপতি সৈয়দ মহসীন পারভেজ বলেন, হাওরের মানুষদের হাওরের পরিবেশ-প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে চলতে হয়। কারণ এখানে আনন্দ যেমন আছে তেমনি দুর্যোগ-দুর্ভোগ ও হাহাকার আছে। তারা সাধারণত সারা বছরের জন্য বোরো মৌসুমে ধান সংগ্রহের পাশাপাশি সব প্রয়োজনীয় ও ব্যবহার্য জিনিসপত্র সংরক্ষণ করেন। তবে হাওরপাড়ে মানুষের জীবনমান এখনো অনেক নিচে। বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে তাদের জীবনমানের উন্নয়ন প্রয়োজন।

মন্তব্য

Beta version