সিলেট নগরীর তেররতন এলাকার বাসিন্দা শিপা বেগম। স্বামী শাহ আলম একজন দিনমজুর। এক ছেলে এক মেয়ে নিয়ে তার সংসার ভালোই চলছিল। কিন্তু সম্প্রতি সিলেটে ভয়াবহ বন্যা তার পরিবারের সব কিছু পাল্টে দিয়েছে। ঘরে পানি ঢুকে নষ্ট হয়েছে মালামাল। বাড়িতে রান্না বন্ধ হয়ে আছে। এখন ইঞ্জিন নৌকা কিংবা ঘরের বাইরে মানুষের শব্দ শুনলেই তারা ত্রাণের আশায় ছুটে আসছেন।
শিপা জানালেন, তিনদিন ধরে ঘরে পানি। রান্না করতে পারছি না। কিভাবে বাঁচবো? কেউ ত্রাণও দিচ্ছে না।
একই এলাকার বাসিন্দা সাথী বেগম বলেন, কত কষ্টে আমরা আছি একটু দেখে যান। পারলে একটু সাহায্য করেন।
শুধু শিপা কিংবা সাথী নয় এরকম অসংখ্য মানুষ পানিবন্দি হয়ে ত্রাণের আশায় বসে আছেন। অনেকের ঘরে থাকা খাবারের মজুত ফুরিয়ে যাওয়ায় মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।
এদিকে সিলেটের সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতি হয়েছে। গত এক সপ্তাহ থেকে সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। সিলেট নগরসহ জেলার ১৩টি উপজেলায় প্লাবিত হওয়া হাজার হাজার গ্রামে এখনো পানি কমছে না। এতে অনেকে কর্মহীন হয়ে পড়েছেন। অন্যদিকে ঘরে মজুত করা খাবারো শেষ হয়ে গেছে। বন্যাদুর্গত মানুষ পর্যাপ্ত ত্রাণ পাচ্ছে না বলেও অনেকে অভিযোগ করেছেন।
সিলেটের গোয়াইনঘাটের পূর্ব জাফলং এলাকার বাসিন্দা নূর ইসলাম বলেন, ঘরে পানি। রান্না করতে পারছি না। সন্তানদের নিয়ে খুব বিপদে আছি। কোনো সহায়তা এখনও পাইনি।
তবে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, ইতোমধ্যে ২৩৪ মেট্রিক টন চাল, ১৩ লাখ নগদ টাকা ও প্রায় ৩ হাজার প্যাকেট শুকনো খাবার দেওয়া হয়েছে। আর জেলা প্রশাসনের হিসাবে ১০৩টি ইউনিয়নের মধ্যে ৫৫টি সম্পূর্ণ ও ১৫টি ইউনিয়ন আংশিকভাবে প্লাবিত হয়ে পড়েছে। পানিবন্দি আছে ১৫ লাখ মানুষ।
সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মো. আনোয়ার সাদাত বলেন, ‘সিলেটে পর্যাপ্ত পরিমাণে ত্রাণসামগ্রী বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিরা প্লাবিত এলাকায় ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দিচ্ছেন। এ ছাড়া জেলা প্রশাসন সার্বক্ষণিক প্লাবিত এলাকা পর্যবেক্ষণ করছে।’
বন্যাকবলিত এলাকায় বিশুদ্ধ পানির সংকট ও স্যানিটেশন সমস্যার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বিদ্যুৎ বিভ্রাট। সব মিলিয়ে বন্যাকবলিতদের দুর্ভোগ এখন চরমে। জেলার অর্ধেক এলাকাই এখন বিদ্যুৎ নেই।
এদিকে বৃহস্পতিবার দিবাগত রাতে জেলার জকিগঞ্জে বারোঠাকুরী এলাকায় ত্রি-মোহনার বরাক-সুরমা-কুশিয়ারা নদীর উৎসস্থলের ডাইক ভেঙে গেছে। এতে পানিবন্দি হচ্ছে উপজেলার প্রায় সবকটি গ্রাম। এতে করে সিলেটের সুরমা নদীতে পানি আরো বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বন্যার কারণে ইতোমধ্যে জেলার প্রায় ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পাঠদান বন্ধ রাখা হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনেক জায়গায় আশ্রয় কেন্দ্র স্থাপন করেছে প্রশাসন। সেখানেও বন্যার পানি ঢুকে পড়েছে। কোম্পানীগঞ্জ, গোয়াইনঘাট, কানাইঘাট উপজেলার অনেক আশ্রয়কেন্দ্রে পানি ঢুকেছে।
জেলার প্রায় ৭০০ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্যার কারণে বন্ধ রয়েছে উল্লেখ করে সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (শিক্ষা) ইয়াসমিন নাহার রুমা বলেন, ‘পাঠদান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের ক্ষতি তো হবেই। কিন্তু প্রাকৃতিক দুর্যোগে তো আমাদেরও কিছু করার নেই। পানি কমলে এই ক্ষতি পুষিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হবে।’
সিলেট জেলা ত্রাণ কর্মকর্তা মো. নুরুল ইসলাম বলেন, ‘বন্যাদুর্গতদের জন্য আমরা ৩২৬টি আশ্রয়কেন্দ্র চালু করেছি। ইতোমধ্যে ৯৫টি আশ্রয়কেন্দ্রে ৭ হাজার ৩৪৯ জন আশ্রয় নিয়েছে। এছাড়া ২৩৮টি গবাদিপশু বিভিন্ন আশ্রয়কেন্দ্রে রাখা হয়েছে।’
সিলেট সিটি করপোরেশনের মেয়র আরিফুল হক চৌধুরী বলেন, ‘পানিবন্দি মানুষের সার্বিক সহযোগিতায় একটি হট লাইন চালু করা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রের সংখ্যা প্রয়োজন হলে বাড়ানো হবে।’
সিলেটের প্রধান আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বলেন, ‘আগামী ২১ মে পর্যন্ত সিলেটে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। উজানে ভারতের মেঘালয়ের পাহাড়ি এলাকায় মেঘ হবে। ২২ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত বৃষ্টিপাত কম হবে।’
সিলেট পানি উন্নয়ন বোর্ডের হিসাবে, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার বেলা ৩টা পর্যন্ত সুরমার পানি কানাইঘাটে ১২ সেন্টিমিটার ও সিলেট পয়েন্টে প্রায় ১৬ সেন্টিমিটার কমেছে।
পাউবো বলছে, কুশিয়ারা নদীর পানি অমলসীদ পয়েন্টে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা ৬টা থেকে শুক্রবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত ৮ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে এই সময়ে ফেঞ্চুগঞ্জে ১৬ সেন্টিমিটার বেড়েছে। কিছুটা কমেছে লোভা, সারি ও ধলাই নদীর পানিও।
পাউবো সিলেটের উপসহকারি প্রকৌশলী নিলয় পাশা জানান, ‘উজানে বৃষ্টি না হলে পানি আরও কমবে। তবে বৃহস্পতিবার রাতে জকিগঞ্জের অমলসীদে একটি বাঁধ ভেঙে নতুন করে কিছু এলাকা প্লাবিত হয়েছে।’
মন্তব্য