সময়টা তখন কাক ডাকা ভোর। হাতে কাস্তে, কাঁধে ভাঁড় আর দুটো রশি নিয়ে ঘর থেকে বেরিয়েছেন জাকির উদ্দিন। উদ্দেশ্য, চুক্তিভিত্তিক ধান কেটে মহাজনের ঘরে তুলে দেবেন। এক্ষেত্রে তার দলে রয়েছেন ১৫ জন। শুধু জাকির উদ্দিনই নন, তার মতো অনেকেই দলবেঁধে এই কাজে নেমেছেন। কারণ এখন ধান কাটার মৌসুম চলছে।
জাকির উদ্দিনের বাড়ি দিনাজপুর জেলার পার্বতীপুর উপজেলার ৭নং মোস্তাপুর ইউনিয়নের আমবাড়ি বালুপাড়া এলাকায়। তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, এখন আমাদের এখানে ধান পাকতে শুরু করেছে। চুক্তিভিত্তিক ধান কাটছি। একবিঘা (৫১ শতাংশ) মাটি ধান কাটছি ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার টাকায়।
যদি মহাজনের বাড়ি থেকে জমি দূরে হয় সেক্ষেত্রে সাড়ে ৫ হাজার আর কাছে হলে ৫ হাজার। আমার দলে রয়েছে ১৫ জন। আমরা চুক্তিভিত্তিক নির্দিষ্ট দামে মহাজনের জমির ধান কেটে দিয়ে আসি, তবে মাড়াই করি না।
গ্রীষ্মকালের এ সময়ই দিনাজপুর জেলায় বোরো মৌসুমের ধান পরিপক্ব হয়। এই ধান কাটতেই জাকির উদ্দিনের দলসহ আরো অনেকেই দলবেঁধে ধান কাটার উৎসবে মেতেছেন ।
মহাজনদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, একবিঘা ধান আবাদে বীজ প্রয়োজন হয় ৩ থেকে ৫ কেজি পর্যন্ত। যার মূল্য প্রতিকেজি ৮০ থেকে ১০০ টাকা পর্যন্ত। অর্থাৎ একবিঘা জমিতে বীজ খরচ ৩০০ থেকে ৫০০ টাকা।
একইভাবে জমি প্রস্তুত খরচ (লাঙল, কোদাল দেওয়া ও রোপণ) চার হাজার থেকে সাড়ে চার হাজার টাকা, কীটনাশক ও সার খরচ ৫ হাজার থেকে ৬ হাজার, সেচের খরচ দুই হাজার থেকে আড়াই হাজার, কাটাই খরচ ৫ হাজার থেকে সাড়ে ৫ হাজার এবং মাড়াই খরচ ৮০০ থেকে এক হাজার।
সুতরাং একবিঘা নিজস্ব জমিতে বোরো ধান আবাদে খরচ হয় প্রায় ১৭ থেকে ২০ হাজার টাকা। আর চুক্তিভিত্তিক জমিতে এই ধান আবাদ করতে গেলে মহাজনদের আরো বেশি গুণতে হয় ১০ হাজার টাকা।
মহাজনরা বলছেন, একবিঘা জমিতে মোট ধান উৎপাদন হয় ২৬ থেকে ৪২ মণ পর্যন্ত। উৎপাদন ভালো হলেও বাজারে দাম না থাকায় লোকসান হয় তাদের। তাই জমির মালিকরা জমি চুক্তিভিত্তিক দিয়ে দেন। এদিকে কৃষি সম্প্রসারণ সূত্রে জানা যায়, ধানের জেলা দিনাজপুরে এবার ১ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়েছে।
এরমধ্যে সদর উপজেলায় ৫৭ হাজার ৭৮৮ হেক্টর, বীরগঞ্জে ১৪ হাজার ৯৫৫ হেক্টর, কাহারোলে ৫ হাজার ৭৫৮ হেক্টর, খানসামায় ৪ হাজার ৫৬৫ হেক্টর, চিরিরবন্দরে ১৮ হাজার ৭০৪ হেক্টর, বোচাগঞ্জে ৯ হাজার ২৫৫ হেক্টর, বিরল উপজেলায় ১৩ হাজার ৩৬৪ হেক্টর, পার্বতীপুরে ২৪ হাজার ৩৫০ হেক্টর, ফুলবাড়ীতে ১৪ হাজার ৫৮৫ হেক্টর, নবাবগঞ্জে ১ হাজার ৮৮০ হেক্টর, বিরামপুরে ১ হাজার ৬৪০ হেক্টর, হাকিমপুরে ৭ হাজার ৫০০ হেক্টর এবং ঘোড়াঘাটে ৯ হাজার ৯৩৫ হেক্টর জমিতে ইরি-বোরো চাষ হয়েছে।
একই ইউনিয়নের মহাদেব আয়মাপাড়া এলাকার সত্যেন কুমার বলেন, আমরা অনেক আনন্দ নিয়েই ধান কাটছি। এখন এটা উৎসব বলা যেতে পারে। কিন্তু কাঁধে নিয়ে যেতে যেতে চামড়া উঠে ঘা হয়ে গেছে। অনেক যন্ত্রণা করে। কিন্তু কি করার। ২০ থেকে ২২ জন মিলে কাটছি। সবাই পারছে তাই আমিও পারছি। একই দলের উত্তম কুমার সরকার বলেন, সবাই মিলে ধান কাটার মজা আছে। যত তাড়াতাড়ি ধান তুলে দিতে পারব তত তাড়াতাড়ি টাকা পাব। একবিঘা ধান কাটলেই মহাজন ৬ হাজার টাকা দেবে আমাদের দলকে। একদিনে আমরা চারবিঘা পর্যন্ত ধান কাটতে পারি।
একই এলাকার মহাজন চোপল কুমার সরকার বলেন, এখন ধানে তেমন একটা লাভ হয় না। একবিঘা জমিতে খরচ হয় প্রায় ১৮ থেকে ২০ হাজার টাকা। খুব ভালো উৎপাদন হলে একবিঘায় ধান পাওয়া যায় ৪০ থেকে ৪২ মণ। আর খুব খারাপ হলে পাওয়া যায় ২৬ থেকে ৩০ মণের মতো। আমি নিজের জমি বর্গা দিয়ে দেই। লাভ হয় না কী করব।
দিনাজপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মনজুরুল হক বলেন, ‘দিনাজপুর জেলায় এ বছর ১ লাখ ৮৪ হাজার ২৭৯ হেক্টর জমিতে বোরো ধানের আবাদ হয়েছে। এখন পর্যন্ত ২০ শতাংশ ধান পেকেছে। সেই ধান কাটতে শুরু করেছে কৃষকরা।’
তিনি আরো বলেন, ‘এপ্রিলের শেষ এবং মে মাসের শুরুতে বোরো ধান পাকতে শুরু করে। এ সময় দেখা যায় কৃষকদের ধান কাটার উৎসব। মাঠে গেলে চোখ পড়ে অনেক দিনমজুর কৃষক দলবেঁধে মাঠে ধান কাটতে যাচ্ছে।’
মন্তব্য