এ বছর কালবৈশাখীর তাণ্ডবে বড় ক্ষতি হয়েছে। ঝড়বৃষ্টির কারণে মাঠেই নষ্ট হয়েছে পাকা ধান। স্থানীয়দের হিসাবে উত্তরাঞ্চলে প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমির ধান ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ফলনের ঘাটতি ২৮ থেকে ৩০ লাখ টন। আর কৃষকের আর্থিক ক্ষতি প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
চাষিরা জানান, বৈশাখের শেষ থেকে জৈষ্ঠ্যের প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত তিন দফা প্রবলবেগে ঝড় বয়ে গেছে। সঙ্গে ছিল বৃষ্টি। কোথাও-কোথাও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। এতে পাকা ও আধপাকা ধান জমিতে হেলে পড়ে। কয়েক দফায় বৃষ্টির কারণে জমিতে জলাবদ্ধতা তৈরি হয়। নিম্নাঞ্চলের জমিগুলোর ধান ডুবে যায়। জলাবদ্ধ জমিতে ধান পড়ে থাকায় চারা গজায়। চোখের সামনে ফলন নষ্ট হয়ে গেছে। শ্রমিক সংকটের কারণে ফলন দ্রুত ঘরে তোলা যায়নি।
কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা জানান, শুধু ঝড়-বৃষ্টির কারণেই মোট ফসলের প্রায় ২০ ভাগ ক্ষতির মুখে পড়ে। প্রায় ১৫ ভাগ ফলন নষ্ট হয়েছে। স্থানীয় চাষিরা জানান, ধান কাটতে গিয়ে চরম বিরম্বনায় পড়তে হয়েছে। পানিতে ডুবে নষ্ট হয়েছে ধান। প্রাণপণ চেষ্টা করেও সব ধান ঘরে তোলা যায়নি। এতে বিঘাপ্রতি ফলন ঘাটতি হয়েছে পাঁচ থেকে সাত মণ পর্যন্ত।
নওগাঁ, বগুড়া ও দিনাজপুরের কয়েকজন চাষি জানিয়েছেন, ডিজেলের মূল্য বাড়ানোয় মৌসুম জুড়েই ঊর্ধ্বমূখী ছিল- হাল, সেচ, সার-বীজ ও কীটনাশকের দাম। বিঘাপ্রতি হালে ১ হাজার, সেচে ১ হাজার ৬০০ থেকে ২ হাজার টাকা খরচ গুনতে হয়েছে। এছাড়া এবার নিড়ানি ও অন্যান্য খরচ পড়েছে বেশি। সবশেষ ভরা মৌসুমে শ্রমিক সংকটের কারণে ধান ঘরে তুলতে দুই গুণ খরচ পড়েছে।
বিঘাপ্রতি শ্রমিকের মজুরি দিতে হয়েছে পাঁচ থেকে ছয় হাজার টাকা। উচ্চমূল্যে ধান উৎপাদন করতে হয়েছে। বিঘাপ্রতি খরচ হয়েছে প্রায় ২০ হাজার টাকা। কিন্তু দুর্যোগে ফলন হারিয়ে বিপরীতে বিঘাপ্রতি লোকসান হচ্ছে পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা।
সংশ্লিষ্টদের হিসাবে নওগাঁ, দিনাজপুর, বগুড়াসহ বরেন্দ্র অঞ্চলে চাষিরা এ বছর প্রায় ৩৫ লাখ হেক্টর জমিতে বোরো চাষ করেন। দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত হয় প্রায় ১৫ লাখ হেক্টর জমির ফসল। এতে প্রতি হেক্টরে ফলন ঘাটতি দাঁড়িয়েছে প্রায় দুই টন। সেই হিসাবে এ অঞ্চলে ফলনের মোট ঘাটতি প্রায় ৩০ লাখ টন। অর্থাৎ মোট উৎপাদনের ১৮ থেকে ২০ ভাগ। প্রতি বিঘায় কৃষকের আর্থিক ক্ষতি হয়েছে প্রায় ৭ হাজার টাকা। হেক্টরপ্রতি ৫২ হাজার ৫০০ টাকা। উত্তরাঞ্চলে কৃষকের মোট ক্ষতি দাঁড়িয়েছে ৭৮০ বা প্রায় ৮০০ কোটি টাকা।
নওগাঁ কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক সামসুল ওয়াদুদ জানান, ক্ষতিগ্রস্ত জমির প্রায় ১০ ভাগ ফলন জমিতেই নষ্ট হয়েছে। চিটার পরিমাণ বেশি হবে। দানা হবে কম। ক্ষতিগ্রস্ত চাষিদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। সরকারিভাবে সহযোগিতা করা হবে বলেন জানান তিনি।
এদিকে ঘটতি পূরণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন চালকল মলিক ও ব্যবসায়ীরা। নওগাঁ জেলা চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার বলেন, ‘প্রাকৃতিক দুর্যোগে কৃষক বড় ধরনের ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উচ্চমূল্যে ধান বিক্রি করেও লাভবান হতে পারছেন না। অন্যদিকে চালের বাজার দর স্থিতিশীল রাখতে ঘাটতি পূরণ করতে হবে। প্রয়োজনে আমদানি করার পরামর্শ দেন তিনি।
নওগাঁ জেলা ধান-চাল আড়তদার সমিতির সভাপতি নিরোদ বরন সাহা চন্দন বলেন, সরকারকে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে। আগের ঘাটতি ছিল প্রায় ২০ লাখ টন। নতুন করে সারাদেশের কী পরিমাণ ঘাটতি হয়েছে সেই পরিসংখ্যান মোতাবেক ব্যবস্থা নিতে হবে। পাশাপাশি আগামী মৌসুমের আগেই কৃষককে প্রণোদনা দিয়ে উৎপাদন বাড়াতে হবে। তা না হলে দেশের খাদ্য সংকট মোকাবিলা কঠিন হবে।
মন্তব্য