-->
শিরোনাম

নিম্নমানের হাসপাতাল, ক্লিনিকের ছড়াছড়ি

সিরাজুল ইসলাম শিশির, সিরাজগঞ্জ
নিম্নমানের হাসপাতাল, ক্লিনিকের ছড়াছড়ি

সিরাজগঞ্জ জেলায় ও উপজেলাগুলোতে প্রতিনিয়িত ব্যাঙের ছাতার মতো গজিয়ে উঠছে অনুমোদনহীন, ভুইফোঁড়, বেসরকারি লাইসেন্সবিহীন নিম্নমানের হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার। এর মধ্যে লাইসেন্স নেই অনেক প্রতিষ্ঠানের। শুধু ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে তারা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসছেন। অনেক ক্লিনিক-ডায়াগনস্টিক সেন্টারের অনুমতি থাকলেও দীর্ঘ কয়েক বছর ধরে তা নবায়ন করা হয় না। কোনো নিয়ম-নীতি না মেনেই বাসা-বাড়ি, হাটবাজার এমনকি অলিগলিতেও চলছে এসব প্রতিষ্ঠানের চিকিৎসা নৈরাজ্য।

প্রশাসনের চোখের সামনে এসব প্রতিষ্ঠান রমরমা ব্যবসা চালিয়ে গেলেও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলো বেশিরভাগ থাকে নীরব। ফলে লাইসেন্স না করেই বা নবায়ন ছাড়াই অসাধু ক্লিনিক মালিকরা তাদের ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন।

জেলা সিভিল সার্জন অফিসের তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জ জেলাতে মোট ১৭৩টি বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার রয়েছে। এর মধ্যে ২০টি প্রতিষ্ঠানের নেই কোনো লাইসেন্স। আর দীর্ঘদিন নবায়ন করেনি এমন প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ৮০টিরও বেশি। আর এই তালিকার বাইরে রয়েছে অসংখ্য নাম না জানা প্রতিষ্ঠান।

এসব প্রতিষ্ঠানে নেই কোনো জরুরি বিভাগ। নেই রোগ নির্ণয়ের মানসম্মত যন্ত্রপাতি, পরীক্ষাগার বা ল্যাব টেকনোলজিস্ট। মাঝেমধ্যে ধার করা পার্টটাইম চিকিৎসক দিয়ে চলছে জটিল অপারেশনসহ নানা রোগের চিকিৎসা। কম বেতনের অনভিজ্ঞ নার্স, আয়া ও দারোয়ানই হচ্ছে এসব ক্লিনিকের একমাত্র ভরসা।

‘কম্পিউটারাইজড’, ‘পূর্ণাঙ্গ ডিজিটাল’ ও নামিদামি চিকিৎসকদের নাম সংবলিত চোখ ধাঁধানো ডিজিটাল সাইনবোর্ডের এসব ক্লিনিকগুলোতে জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলের অসহায় মানুষ রোগ নিরাময়ের জন্য এসে অপচিকিৎসার জালে আটকা পড়ছেন। জেলা কিংবা উপজেলা স্বাস্থ্য বিভাগের পক্ষ থেকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত মনিটরিং কিংবা জবাবদিহি না থাকায় অবৈধ ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, জেলার বিভিন্ন হাটবাজারে অবস্থিত সরকারি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোকে ঘিরে গড়ে ওঠা দালালনির্ভর এসব নার্সিং হোম, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে গিয়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে নিরীহ মানুষ। প্রসূতি মায়েদের গর্ভের সন্তান সিজার করার সময় একাধিক শিশু ও মায়ের মৃত্যুর খবরও রয়েছে অনেক।

এক শ্রেণির দালাল ও সরকারি হাসপাতালের কর্মকর্তা-কর্মচারী মিলে সিন্ডিকেট করেই এসব প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। বিভিন্ন সময় ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে এসব অবৈধ হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ভুয়া ডাক্তারের বিরুদ্ধে অভিযান চললেও নানা কৌশলে প্রতিষ্ঠানগুলো সচলই থাকে ১২ মাস।

সরজমিনে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার কড্ডার মোড়ে ইস্কয়ার হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ল্যাব এইচ হাসপাতাল অ্যান্ড ডায়াগনস্টিক সেন্টার, সিরাজগঞ্জ পল্লী ক্লিনিক অ্যান্ড সমরিতা ক্লিনিক, বেলকুচি উপজেলার রাজাপুর ইউনিয়নে সমেসপুর বাজারে সুমনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড হাসপাতাল, জননী ডায়াগনস্টিক সেন্টার, শেখ রায়হান আলী ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কুয়াশা ডায়াগনস্টিক অ্যান্ড কনসালটেশন সেন্টারসহ অর্ধ-শতাধিক হাসপাতাল, ক্লিনিক ও ডায়াগনস্টিক সেন্টার ঘুওে দেখা যায়, তাদের লাইসেন্স নবায়ন নেই দীর্ঘদিন ধরে।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ক্লিনিকে সেবা নিতে আশা ভুক্তভোগী রোগীরা জানান, পরীক্ষার নামে তাদের হয়রানি করা হয়। এছাড়া পরীক্ষায় অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। এভাবে হয়রানি চললে সঠিক চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব হবে না।

মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার অ্যান্ড হসপিটালে চিকিৎসা নিতে আসা ইসমাইল হোসেন জানান, সকাল ১০টার সময় চিকিৎসার জন্য এসেছেন তিনি। এসে দীর্ঘসময় বসে থাকার পরও ডাক্তারের কোনো খবর নেই। দুই থেকে তিনজন নার্স শুধু এদিক-ওদিক দৌড়াদৌড়ি করছেন আর কাউন্টারে ম্যানেজার বসে আছেন। এরা শুধু মাইকিং করে বেড়ান। সঠিক সেবা দেওয়ার নাম নেই। ডাক্তারও ঠিকমতো থাকেন না।

বেলকুচি সেন্ট্রাল হসপিটালে চিকিৎসা নিতে আসা আহসান হাবিব জানান, প্রচার-প্রচারণা দেখে চিকিৎসা নিতে এসেছেন তিনি। কিন্তু এসে দেখে ডাক্তার ঠিকমতো নেই। তার মতো অনেকেই এসে বসে আছে। হাসপাতালে রোগীর ভালো মানের বেড নেই, জায়গাও সংকট। পরিবেশও খুব একটা ভালো না। এরা চিকিৎসা দেওয়ার নামে তাদের সঙ্গে নাটক করছে।

তিন বছরের লাইসেন্স নবায়ন নেই কেন? এ বিষয়ে মদিনা জেনারেল হাসপাতালের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আকতারুজ্জামান বলেন, ‘আগে সরাসরি ডিজি অফিসে টাকা জমা দিলেই নবায়ন হতো এখন চালানের মাধ্যমে ব্যাংকে টাকা জমা দিতে হয়। আগে পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগেনি এখন লাগছে, আগে শ্রম অধিদপ্তরের ছাড়পত্র লাগেনি এখন লাগছে। আর এসব কারণে সময়মতো কাগজপত্র সংগ্রহ করতে না পারায় নবায়ন হয়নি।’অপরদিকে ইস্কয়ার হাসপাতালের ম্যানেজার আবু হানিফা ও জননী ডায়াগনস্টিক সেন্টারের মালিক সিরাজুল ইসলাম বলেন, ‘সিভিল সার্জন অফিস থেকে লাইসেন্স নবায়নের জন্য সময় বেঁধে দিয়েছে। শিগগিরই চালান কেটে ব্যাংকে টাকা জমা দিয়ে দেব।’

এতদিন জমা দেননি কেন? জিজ্ঞাসা করলে তারা জানান, এতদিন এতটা চাপ ছিল না।

সিরাজগঞ্জ সিভিল সার্জন ডা. রামপদ রায় বলেন, ‘সম্প্রতি নিবন্ধন না থাকায় সিরাজগঞ্জে ১৪টি বেসরকারি হাসপাতাল ও ক্লিনিক বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। আর হালনাগাদ বা নবায়নকৃত কাগজপত্র না থাকায় ৯০টি প্রতিষ্ঠানকে সতর্ক করেছে স্বাস্থ্য বিভাগ। যারা নবায়ন করেননি তাদের আগামী ১৫ জুনের মধ্যে কাগজপত্র হালনাগাদ করতে বলা হয়েছে। অন্যথায় পরবর্তী সময়ে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

মন্তব্য

Beta version