-->
শিরোনাম

ঢলন প্রথায় জিম্মি আম চাষি

‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’

তারেক মাহমুদ, রাজশাহী
ঢলন প্রথায় জিম্মি আম চাষি

রাজশাহী জেলার সবচেয়ে বড় আমের হাট বানেশ্বর। এখানে হাট থেকে আম কিনে বিভিন্ন মোকামে নিয়ে যান পাইকাররা। এ মোকামগুলোয় মোট ১২৬ ব্যবসায়ী রয়েছেন। দীর্ঘদিন থেকে এ ব্যবসায়ীরাই সিন্ডিকেট করে স্থানীয় আম চাষি ও বিক্রেতাদের ঠকাচ্ছে। চক্রটি কয়েক বছর ধরেই ঢলন ও শোলা প্রথার নামে চাষিদের নানাভাবে ঠকিয়ে আসছে। এ যেন ‘লাভের গুড় পিঁপড়ায় খায়’-এর মতো অবস্থা।

এদিকে এ বিষয়ে একাধিকবার সমাধানের জন্য আলোচনা করেও সিন্ডিকেটের লাগাম টেনে ধরতে পারছে না খোদ প্রশাসনও। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রশাসন তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হলে সিন্ডিকেট আম কেনা বন্ধ রাখেন। কৃষক গাছে থেকে হাটে আম নিয়ে আসে, কিন্তু পাইকাররা হাটে আসেন না। দীর্ঘসময় রোদে পুড়ে হাটে বসে থাকেন কৃষক। দুপুরের পরে ও বিকেলে পাইকার বাজারে এসে অল্প দামে চওড়া ঢলন প্রথায় আম নিয়ে যান।

এদিকে গত বছর করোনার অজুহাতে চক্রটি প্রতি মণে ১০ কেজি বেশি আম নিয়েছে। এ নিয়মকে তারা বলছেন ‘ঢলন’। এবার আরো এক কেজি বাড়িয়ে নেওয়া হচ্ছে ১১ কেজি। যেখানে ৪০ কেজিতে ১ মণ ধরা হয় সেখানে ৫১ কেজিতে ১ মণ আম কৃষকের কাছে থেকে নিচ্ছেন সিন্ডিকেট। হাটে আম বিক্রি করতে আসা চাষিরা জানান, বাজারের আম ব্যবসায়ীদের কাছে তারা জিম্মি। বিষয়টি বাজার কমিটি ও উপজেলা প্রশাসনকে একাধিকবার জানিয়েও কোনো লাভ হয়নি।

চলতি মাসের কয়েকদিন বানেশ্বর হাটে দেখা যায়, বাজারের বেশিরভাগ ক্রেতা স্থানীয় ফড়িয়া ও আড়তদার। হাতেগোনা কয়েকজন ব্যবসায়ী বাইরে থেকে এসেছেন। তারা আম কিনছেন মণ ও চুক্তি দুভাবেই। প্রতি মণে নেওয়া হচ্ছে গড়ে ৫০ থেকে ৫১ কেজি আম। সে হিসেবে বিক্রেতাকে প্রতি মণে ঢলন দিতে হচ্ছে ১০-১১ কেজি। বানেশ্বর বাজারে আসা আমবাগান মালিক মজনু ইসলাম বলেন, বাজারে আম বিক্রি করতে এসে ব্যবসায়ীদের কাছে জিম্মি হয়ে থাকতে হয়। তারা যেভাবে পারছে বিক্রেতাদের লুট করছে।

জাকির হোসেন নামে আরেক চাষি বলেন, অতিরিক্ত আম নেওয়ার বিষয়টি প্রতি বছরই বাজার কমিটি বা স্থানীয় প্রশাসনকে জানানো হয়। আর ঢলন প্রথা বাতিল করতে বাজার কমিটি ও উপজেলা প্রশাসন ব্যবসায়ীদের নিয়ে প্রতি বছর দু-একবার বৈঠক-সমাবেশ হয়। কিন্তু বাস্তবে এর কোনো সুফল আম চাষিরা পাচ্ছেন না।’

রিপন আলী নামে আম বিক্রেতা বলেন, এ বাজারে আম বিক্রি করতে হলে চাষিদের কয়েকটি ধাপে ভর্তুকি দিতে হয়। এর মধ্যে আড়তদার ঢলন নেয় প্রতি মণে ৯ কেজি। ওজনকারী প্রতি মণ মাপার আগে শোলার নামে বড় দুটি আম আলাদা করে রাখে। এরপর ওই ওজনকারীরা বাড়িতে খাওয়ার কথা বলে সব বিক্রেতার কাছ থেকে দু-তিনটা করে আম নেয়। এরপর আম বিক্রির দাম পরিশোধ করার সময় হিসাবরক্ষক বাটার নামে হিসাবরক্ষকের কমিশন ২০-৫০ টাকা পর্যন্ত কেটে নেয়। এ বিষয়ে জানতে চাইলে বানেশ্বর বাজারের ব্যবসায়ী ও হাট ইজারদার ওসমান আলী বলেন, ‘আম কাঁচামাল, এটার কিছু ভর্তুকি তো আছেই। এ অজুহাতে ব্যবসায়ীরা মণ হিসেবে অতিরিক্ত কিছু আম নেন। আর এ কারণে ঢলন প্রথা তুলে দিতে আমরা ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করি। বিভিন্নভাবে বোঝানোর পরও সেটা কার্যকর হচ্ছে না।’

আম ব্যবসায়ীরা অবশ্য অতিরিক্ত আম দিতে কাউকে বাধ্য করার অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। তারা বলেন, ‘এখানে কোনো বিক্রেতার কাছ থেকে জোর করে আম নেওয়া হয় না। কেনার সময় তাদের বলা হয় প্রতি মণে কত কেজি ঢলন দিত হবে। তাদের ইচ্ছে হলে দেবেন, আর না হলে নয়।’ পুঠিয়া উপজেলা নিবাহী অফিসার নূরুল হাই মোহাম্মদ আনাস বলেন, ‘এ সমস্যা শুধু বানেশ্বর আমের হাটেই নয়, চাঁপাইনবাগঞ্জ ও বিভিন্ন জেলায় এ প্রথা। বানেশ্বরে এ সমস্যা অনেক দিনের। গত বছর স্থানীয় প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী নিয়ে আমরা ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেছিলাম। তাদের বলার পরে কিছুদিন ব্যবসায়ীরা মণপ্রতি কম রেখেছিল। এবারো তাদের বলা হয়েছে ঢলন প্রথা বাদে আম কিনতে। বিষয়টি নিয়ে আবারো বলব, আলোচনা করব। আশা করি, এ প্রথা বাদে আড়তদাররা সঠিকভাবে আম কেনাবেচা করবেন।’

মন্তব্য

Beta version