-->
মির্জাপুরে বংশাই ও ঝিনাই নদীর ভাঙন

নদীগর্ভে বিলীন ঘরবাড়িসহ কয়েকশ একর আবাদি জমি

আ. রশিদ তালুকদার, টাঙ্গাইল
নদীগর্ভে বিলীন ঘরবাড়িসহ কয়েকশ একর আবাদি জমি

টাঙ্গাইল: যমুনায় অসময়ে ফের পানি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে টাঙ্গাইলের অভ্যন্তরীণ নদীগুলোরও পানি বাড়ছে। ফলে টাঙ্গাইলের বংশাই ও ঝিনাই নদীর তীরের মির্জাপুর উপজেলার ফতেপুর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রামের ঘরবাড়িসহ ও কয়েকশ একর আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। মির্জাপুর উপজেলা সদরের সঙ্গে উত্তর মির্জাপুরের যোগাযোগ রক্ষাকারী কুর্ণী-ফতেপুর সড়কটি ইতোমধ্যে ভাঙনের কবলে পড়েছে। ভাঙন রোধে হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন তাৎক্ষণিকভাবে লবণ, চিনি, দুধ, কলা ইত্যাদি ভোগ হিসেবে নদীতে নিক্ষেপ করে গঙ্গা মায়ের করুণা প্রার্থনা করছেন।

 

স্থানীয়রা জানান, প্রকৃতিতে সকালের কুয়াশা শীতের আগমনী জানান দিচ্ছে। এ সময় বংশাই ও ঝিনাই নদীর পানি বাড়ছে- এটা তারা আগে কখনও দেখেননি। বংশাই ও ঝিনাই মির্জাপুর উপজেলা দিয়ে বয়ে যাওয়া দুটি নদী। পাশাপাশি এলাকা দিয়ে গিয়ে ধলেশ্বরীর সঙ্গে ত্রিসঙ্গমে মিলিত হয়েছে। দুই সপ্তাহ ধরে পানি বাড়ার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বংশাই ও ঝিনাই নদীর ভাঙনও বাড়ছে। ফতেপুর ইউনিয়নের থলপাড়া, ফতেপুর, বানকাটা, চাকলেশ্বর, বৈলানপুর, পাতিলাপাড়া ও ভাতগ্রাম ইউনিয়নের গোড়াইলের নদী-তীরবর্তী এলাকায় ভাঙন শুরু হয়েছে। গত তিন দিনের ভাঙনে এরই মধ্যে সড়ক, ঘরবাড়ি ও আবাদি জমি নদীগর্ভে চলে গেছে। বানকাটা ও গোড়াইল গ্রামের দরিদ্র পরিবারের অনেকেই বসতবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে পড়েছেন। হিলড়া বাজারের উত্তর পাশের অধিকাংশ জায়গা এবং বাজারের পাশে এলজিইডির সড়ক-কালভার্ট ভেঙে গেছে। নদী-তীরবর্তী এলাকার শত শত একর আবাদি জমি ইতোমধ্যে নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। এ ছাড়া মির্জাপুর উপজেলা সদরের সঙ্গে ফতেপুর ইউনিয়নের যোগাযোগের প্রধান মাধ্যম কুর্ণী-ফতেপুর সড়কের ফতেপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে নতুন করে ভাঙন শুরু হয়েছে।

 

ভাঙনে সড়কের বেশিরভাগ অংশ নদীর পেটে চলে গেছে। ফতেপুর বাজারের পালপাড়া গ্রামের ১০-১২টি বাড়ি যে কোনো সময় ভাঙনের হুমকিতে রয়েছে। ফলে কুর্ণী-ফতেপুর সড়ক দিয়ে সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। স্থানীয়রা জানান, ফতেপুর ইউনিয়নের ফতেপুর, বানকাটা, থলপাড়া, পারদিঘি, বৈলানপুর, সুতানরি ও মহেড়া ইউনিয়নের তেঘুরি, ভাতকুড়া, ছাওয়ালী গ্রামের শত শত লোকজন ফতেপুর বাজার ঘাট থেকে ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মির্জাপুর সদরসহ বিভিন্ন স্থানে চলাচল করত। এলাকাবাসীর দাবির মুখে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর (এলজিইডি) গণমানুষের দুর্ভোগ লাঘবে প্রায় দেড় যুগ আগে তিন কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে কুর্ণী-ফতেপুর সড়ক পাকা করে। এরপর থেকে ওই সড়কে যানবাহন চলাচল করতে শুরু করে। স্থানীয়দের দীর্ঘদিনের দুর্ভোগের লাঘব হয়।

 

অসময়ে নদীতে পানি বৃদ্ধির ফলে সড়কটিতে ভাঙন দেখা দেয়ায় সব ধরনের যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। থলপাড়া এলাকায় পাশের জমির ওপর দিয়ে সীমিতভাবে শুধু স্থানীয়দের মোটরসাইকেল, সিএনজিচালিত অটোরিকশা, রিকশা ও ভ্যান চলাচল করতে পারলেও ফতেপুর বাজারের পালপাড়া এলাকায় সড়কের পাশে ঘরবাড়ি থাকায় সে অবস্থাও নেই। অতিদ্রুত ভাঙন রোধ করা না গেলে সড়কটি নদীর পেটে চলে যাওয়ার আশঙ্কা এলাকাবাসীর। গত ২-৩ দিনের ভাঙনে ইতোমধ্যে ফতেপুর বাজারের দক্ষিণ পাশে সড়কের প্রায় তিনশ’ ফুট এবং থলপাড়া এলাকায় প্রায় ছয়শ’ ফুট নদীগর্ভে চলে গেছে। ভাঙনের কবল থেকে সড়ক ও ঘরবাড়ি রক্ষায় অনেকেই ভাঙনস্থলে গাছ ও বাঁশ ফেলে প্রতিরোধের চেষ্টা করছেন।

 

নদীতে ভাঙন যাতে না হয়, সে জন্য স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজন গঙ্গা মায়ের নামে ভোগ দিচ্ছেন। অনেকেই লবণ, চিনি, দুধ, কলা, বাতাসা, মিষ্টিসহ হিন্দু শাস্ত্রের নিয়মানুযায়ী যা যা দিতে হয়, তার সব নদীতে নিক্ষেপ করছেন। ফতেপুর বাজারের পালপাড়া এলাকার ১০-১২ জন নারী জানান, নদী ভাঙন রোধে তারা গঙ্গা মায়ের করুণা প্রার্থনা করছেন। মায়ের কৃপা পেলে নদী ভাঙনের কবল থেকে তারা রক্ষা পাবেন। এ জন্য পূজা শেষে তারা গঙ্গা মায়ের নামে ভোগ দিচ্ছেন। গঙ্গার কাছে বাড়িঘর রক্ষার কামনা করে তারা অনেকেই লবণ, চিনি, দুধ, কলা, বাতাসা, মিষ্টিসহ বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী নদীতে ছুড়ে দিচ্ছেন।

 

ফতেপুর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. ফরিদ মিয়া জানান, কুর্ণী-ফতেপুর সড়ক দিয়ে থলপাড়া, বৈলানপুর, সুতানরি, হিলড়া ও আদাবাড়ি গ্রামের শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ে আসা-যাওয়া করে। সড়কটি রক্ষা করা না গেলে শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসী চরম দুর্ভোগে পড়বে।

 

ফতেপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আলতাফ হোসেন ও বর্তমান সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ জানান, এতদাঞ্চলের শত বছরের ঐতিহ্য ফতেপুর হাট। এ হাটে আগে বংশাই ও ঝিনাই নদী দিয়ে পাট ও নারিকেল ভর্তি নানা ডিজাইনের বড় বড় নৌকা আসা-যাওয়া করত। এ ঐতিহ্যবাহী হাটের একমাত্র সড়কটি নদী ভাঙনের কবল থেকে রক্ষায় তিনি পানি উন্নয়ন বোর্ডের জরুরি হস্তক্ষেপ দাবি করেন।

 

ফতেপুর ইউপি চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুর রউফ জানান, কুর্ণী-ফতেপুর সড়ক দিয়ে উত্তর মির্জাপুর ও পাশের বাসাইল উপজেলার হাজারো মানুষ চলাচল করে থাকে। সড়কটি নদী ভাঙনের হাত থেকে রক্ষায় তিনি কর্তৃপক্ষের দ্রুত পদক্ষেপ নেয়ার জোর দাবি জানান।

 

টাঙ্গাইল এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম জানান, নদী ভাঙনের বিষয়টি মূলত বাপাউবোর। তারপরও তিনি স্থানীয় বাপাউবোর নির্বাহী প্রকৌশলীর সঙ্গে কথা বলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার অনুরোধ করবেন। টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন জানান, ইতোমধ্যে সংশ্লিষ্ট এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। ভাঙন রোধে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া হবে।

 

মন্তব্য

Beta version