রুবেল দাশ, চট্টগ্রাম: চট্টগ্রামে শিশু যৌন নির্যাতনের হার বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। গত ১০ মাসে ১৬২ শিশু যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছে বলে জানা গেছে।
চট্টগ্রাম নগরের জামাল খান কুসুমকুমারি বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রথম শ্রেণির ছাত্রী মারজান হক বর্ষা। ২৪ অক্টোবর বিকেলে চিপস কিনতে বাসা থেকে বেরিয়ে নিখোঁজ হয় সাত বছরের এই শিশু। ঘটনার তিন দিন পর নালার পাশে মিলে তার বস্তাবন্দি লাশ। মরদেহ উদ্ধারের পর সন্দেহজনক বেশ কয়েকজনকে আটকের পর জিজ্ঞাসাবাদে এ হত্যাকাণ্ডের দায় স্বীকার করে নেয় ওই এলাকার প্রতিবেশী মুদির দোকানের কর্মচারী।
গ্রেপ্তারের পরই সে জানায়, চিপস কিনে বাসায় ফেরার সময় জোর করে ওই শিশুকে মুদির দোকানের গোডাউনে নিয়ে জোরপূর্বক ধর্ষণ করে। ধর্ষণের পর রক্তাক্ত জখম হলে ভয়ে ওই শিশুকে মুখ ও নাক চেপে শ্বাসরোধে খুন করে। পরে গোডাউনে থাকা বস্তায় ভরে গোডাউনের ডান পাশে দেয়ালের ওপর দিয়ে নালায় ফেলে দেয় লাশ। শিশু বর্ষাকে ‘টার্গেট’ করে কখনো চিপস-চকলেট, কখনোবা টাকা দিয়ে বশে আনে। পরে ঘূর্ণিঝড় সিত্রাংয়ের দিনে মানুষের আনাগোনা কমে গেলে সুযোগ বুঝে এ ঘটনা ঘটায়।
একইভাবে ধর্ষণের পর হত্যার আরেকটি ঘটনা ঘটে ১৮ সেপ্টেম্বর নগরের বন্দর থানাধীন পোর্ট কলোনি এলাকায়। আগের দিন ১৭ সেপ্টেম্বর রাতে বিরিয়ানি খাওয়ানোর কথা বলে নোয়াখালীর বাসিন্দা রিকশা চালক মিন্টু সুরমা আক্তারকে রিকশায় করে পোর্ট কলোনির একটি পরিত্যক্ত ভবনে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে তাকে পাশবিক কায়দায় ধর্ষণ করে। এ সময় সুরমা চিৎকার করলে তাকে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে মরদেহ রেখে পালিয়ে যায় মিন্টু। পরে ১৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে বন্দর এলাকার পোর্ট কলোনির একটি পরিত্যক্ত একতলা পাকা ভবন থেকে সুরমা আক্তার নামে সাত বছর বয়সি ওই শিশুর মরদেহটি উদ্ধার করে বন্দর থানা পুলিশ। সে সময় পরিবারের পক্ষ থেকে একজন রিকশাচালককে সন্দেহ করার কথা বলা হয়েছিল।
এরপর ঘটনার প্রায় ২৪ দিনের মাথায় বুধবার ১২ অক্টোবর বিকেলে আগ্রাবাদের ছোটপোল এলাকা থেকে ওই অভিযুক্ত রিকশাচালক ওসমান হারুন মিন্টুকে গ্রেপ্তার করে বন্দর থানা পুলিশ।
এভাবে প্রতিনিয়িত চকলেট, চিপস, বিরিয়ানি অথবা নানা খাবারের লোভ দেখিয়ে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চালাচ্ছে ‘অপরিচিত’ আপনজন-প্রতিবেশীরা। আর তাদের এমন পাশবিকতা লুকাতে ধর্ষণের পর করছে হত্যাকাণ্ডও। নিকটজনদের কাছে শিশুরা এভাবে যৌন নির্যাতনের শিকার হওয়ার ঘটনা ক্রমান্বয়ে বাড়ছে।
ধর্ষণ ঘটনায় দায়ের হওয়া অর্ধশতাধিক মামলার নথি পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, ভুক্তভোগীদের বেশিরভাগই শিশু এবং কিশোর-কিশোরী, যাদের বয়স পাঁচ থেকে ১৭ বছর। শতকরা হিসেবে ৬০ শতাংশের বেশি ভুক্তভোগী হচ্ছে মেয়ে শিশু। তাদের ফুসলিয়ে অথবা জোরপূর্বক ধর্ষণ করা হচ্ছে।
সিএমপির তথ্যমতে, নগরের থানাগুলোর মধ্যে ২০১৭ সালে ধর্ষণের ঘটনায় ১০৮টি, ২০১৮ সালে ১৩০টি, ২০১৯ সালে ১৯৫টি, ২০২০ সালে ২৪৮টি এবং ২০২১ সালে ২৫১টি মামলা হয়। তবে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত শিশু ধর্ষণের ঘটনায় মামলা হয়েছে ১৬২টি।
এদিকে চলতি মাস অর্থাৎ গত ২ নভেম্বর নগরের আকবারশাহতে এক শিশুকে চিপসের লোভ দেখিয়ে এলাকার একটি নির্জন স্থানে নিয়ে যায় প্রতিবেশী রিকশাচালক আলমগীর। সেখানে শিশুটির ওপর যৌন নির্যাতন চালায়। অভিযোগ পেয়ে রাতে আলমগীরকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। গ্রেপ্তারের পর ৫ বছর বয়সি শিশুটিকে চিপসের লোভ দেখিয়ে যৌন নির্যাতন করেছেন বলে আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছেন ওই আসামি।
এর আগের মাস ১৫ অক্টোবর দুপুরে আরেকটি ঘটনা ঘটে নগরের খুলশী এলাকায়। সেদিন দুপুরে ওই এলাকার একটি ভবনের পেছনে নিয়ে গিয়ে ৮ বছরের শিশুকে ধর্ষণ করে প্রতিবেশী ‘নানা’ নজির আহম্মদ (৫২)। ধর্ষক নজিরের একটি ভাতের হোটেল ছিল। আর তার পাশেই ওই শিশুর বাবা ভাসমান পান-সিগারেট বিক্রি করতেন। পার্শ্ববর্তী দোকান হওয়ায় বৃদ্ধের সঙ্গে ওই পরিবারের সবার সু-সম্পর্ক ছিল। শিশুটিও বৃদ্ধ নজির আহম্মেদকে ‘নানা’ বলে ডাকত। আর ওই বৃদ্ধও প্রায় সময় তাকে ‘নাতনি’ বলে ডেকে কিছু খাবার-দাবার হাতে দেয়। ঘটনার দিন দুপুরে ওই শিশুকে কিছু কিনে খাওয়ার জন্য ৫ টাকা দিয়ে তার সাথে যেতে বলে প্রতিবেশী ‘নানা’। সে যেতে না চাইলে আরো টাকা এবং খাবার কিনে দেয়ার প্রলোভন দেখিয়ে বিজিএমইএ ভবনের পেছনে তার ঘরে নিয়ে যায়। সেখানে ওই শিশুকে ধর্ষণ করে। শিশুটি চিৎকার করলে অভিযুক্ত বৃদ্ধ তার মুখ চেপে ধরে। পরে দরজা খুলে তাকে বাসায় যেতে বলে এবং কাউকে কিছু বলতে বারণ করে। যদি কাউকে বলে তাহলে প্রাণে মেরে ফেলার হুমকিও দেয়। ঘটনার পর থেকে আসামি পলাতক ছিল। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় আসামি নজির আহম্মদের অবস্থান শনাক্ত করে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
এভাবে ১৩ মার্চ নগরের হালিশহর থানা এলাকায় পঞ্চম শ্রেণি পড়ুয়া এক শিক্ষার্থীকে ধর্ষণের পর হত্যা করে। ঘটনার দিন সকালে শিশুটি কোচিং শেষে বাসায় আসে। তখন প্রতিবেশী আলমগীর তাকে বাসায় ডেকে নিয়ে ধর্ষণ করে। পরে শিশুটির গলায় ওড়না পেঁচিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করে। পরে পুলিশ প্রতিবেশী আলমগীর মিয়ার বাসার খাটের নিচ থেকে হাত-পা বাঁধা অবস্থায় ওই শিশুর লাশ উদ্ধার করে। এ ঘটনায় গত ১৪ মার্চ শিশুর বাবা বাদী হয়ে হালিশহর থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করে। ঘটনার দিন পর জড়িত অভিযোগে আলমগীরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
বিষয়টি সম্পর্কে সিএমপির অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (পিআর) পংকজ দত্ত ভোরের আকাশকে বলেন, ‘নগরে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতনের ঘটনা বাড়ছে। তবে শিশুদের ওপর এমন পাশবিক নির্যাতন করছে তাদের আপনজন-প্রতিবেশীরা। তাই পরিবারের উচিত শিশুদের দিকে খেয়াল রাখা। তাদের প্রতি সচেতনতা বাড়ানো পরিবারের সবার দায়িত্ব।’
তিনি আরো বলেন, ‘নিকটাত্মীয়রা শিশুদের ওপর এমন নির্যাতন চালালেও অনেক শিশু সেটা পরিবারের সদস্যদের জানাতে পারে না। এ ঘটনায় অনেক শিশু বাকরুদ্ধ হয়ে যায়। ধীরে ধীরে ওইসব মানুষকে শিশুরা ভয় পেতে শুরু করে। আবার অনেকে শিশুদের ওপর যৌন নির্যাতন চালিয়ে তাদের প্রাণে মেরেও ফেলছে। যাতে তার এমন কর্মকাণ্ড বাইরে প্রকাশ না হয়।
পুলিশের দিকে থেকে পদক্ষেপের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শিশুদের পরিবারের সদস্যদের সচেতনতা বাড়াতে আমরা বিট পুলিশিং, কমিউনিটি পুলিশিং করি। যাতে যারা অভিভাবক আছেন, তারা যেন তাদের শিশুদের নজরদারির মধ্যে রাখে। যাতে এ ধরনের কোনো দুর্ঘটনা না ঘটে। এরপরও অনেক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা ঘটে যায়; তখন আমাদের চেষ্টা থাকে দ্রুত সময়ের মধ্যে আসামিদের গ্রেপ্তার করার।’
শিশু ধর্ষণ মামলার বিষয়ে গুরুত্বের কথা জানিয়ে এ পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ‘যেকোনো অপরাধই গুরুত্ব হিসেবে দেখা হয়। তবে শিশু নির্যাতনের ঘটনাই আলাদাভাবে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হয়। শিশুদের জন্য নারী-শিশুবান্ধব ডেস্ক আছে। মহিলা কর্মকর্তার মাধ্যমে তাদের বক্তব্য শুনে ঘটনার বিস্তারিত জেনে নেয়া হয়। এরপর আসামিকে দ্রুততার মধ্যে সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে গ্রেপ্তার করে আদালতে সোপর্দ করা হয়। পরে আদালত আসামিদের শাস্তি দেন।’
এ প্রসঙ্গে শিক্ষাবিদ ড. আনোয়ারা আলম ভোরের আকাশকে বলেন, ‘মানুষের মধ্যে আচরণ ক্ষেত্রে নেতিবাচক-ইতিবাচক থাকে। শুধু যে কন্যাশিশুর প্রতি নির্যাতন-নিপীড়ন হচ্ছে তা নয়; ছেলে শিশুর প্রতিও এসব হচ্ছে। এসব স্কুল-মাদ্রাসার মধ্যে হচ্ছে; তবে বাইরে আসে না।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য