এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার : দীর্ঘদিন পর আবারো রোহিঙ্গা ক্যাম্পে ছদ্মবেশে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম নিরবে নিভৃতে দাওয়াতী কার্যক্রম শুরু করেছে।
একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্রের অভিযোগ, দেশের সার্বিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিবেচনায় পুরোনো রোহিঙ্গা যারা সব সময় ক্যাম্পের বাইরে থেকে নানা অপকর্মের কলকাঠি নাড়ে তাদের হাত ধরে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমসহ সক্রিয় হচ্ছে একাধিক জঙ্গি সংগঠন। রোহিঙ্গা নিয়ন্ত্রিত কক্সবাজার শহর ও পাশ্ববর্তী অঞ্চলে গড়ে উঠা ১৯টি মাদরাসাকে টার্নিং পয়েন্ট ধরে নতুন করে সংগঠিত হচ্ছে ছদ্মবেশী জঙ্গীরা।
এ ব্যাপারে মাদরাসাতে চলছে দফায় দফায় বৈঠক। স্থানীয়দের অভিযোগ, এসব রোহিঙ্গা অধ্যূষিত প্রতিষ্ঠানে অপরিচিত লোকজনের আনাগোনা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। শুধু তাই নয়,গভীর রাতে গরু-ছাগল জবাই করে তা রাতেই ভাগ-বাটোয়ারা হচ্ছে। এসব অপকর্মের নেতৃত্বে রয়েছেন রোহিঙ্গা নেতা শাইখ ছালামত উল্লাহ, মৌলভি শফিক, কামাল হোসেন, ইদ্রিস জিহাদীসহ ৫ শতাধিক পুরোনো রোহিঙ্গা। তারা ইতোপূর্বে একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়েছিলেন জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে।
এদের অনেকে রামু বৌদ্ধ মন্দির, বিহার ও বসতবাড়ি ভাঙচুর, অগ্নি সংযোগ মামলার তালিকাভুক্ত আসামি। ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কাউন্টার টেরোরিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল (সিটিটিসি) সদস্যরা রাজধানীর রামপুরা থেকে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের ৩ সদস্যকে গ্রেপ্তারের পর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের চিহ্নিত কয়েকজন মাঝি ও পুরোনো রোহিঙ্গা নেতাদের মধ্যে গ্রেপ্তার আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। গ্রেপ্তারকৃতরা কোন কোন এনজিও সংস্থা ও রোহিঙ্গা নেতা তাদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে সহযোগিতা করছেন তাদের তালিকা পেশ করেন। তাদের তালিকার শীর্ষে রয়েছেন শাইখ ছালামত উল্লাহ।
সূত্র জানিয়েছে, ২০১৭ সালে মানবতার দোহাই দিয়ে সাহায্যের আড়ালে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে উগ্রবাদ ছড়িয়েছে আনসার আল ইসলামসহ একাধিক জঙ্গি সংগঠন। এর আগে, টেকনাফ ও উখিয়ার দুটি শিবিরে রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল তুলনামূলকভাবে কম। ১৯৯২ সাল থেকেই বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে রোহিঙ্গাদের সন্ত্রাসী স্টাইলে গড়ে তুলেছে একাধিক উগ্রপন্থী সংগঠন।
২০১৭ সালে রোহিঙ্গাদের ত্রাণ সাহায্য দেয়ার নামে সক্রিয় ছিল আনসার আল ইসলাম। শিবিরে রোহিঙ্গাদের উগ্রবাদ মতাদর্শ প্রচার ও উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টায় অবস্থান করা আনসার আল ইসলাম সদস্য মারুফ চৌধুরী মিশু ওরফে ফারহানের সঙ্গে কিছু হেড মাঝি ও পুরোনো কতিপয় রোহিঙ্গা নেতার সহযোগিতা ছিল বলে জানা গেছে।
স্থানীয়রা বলেন,আমরা শুধু রোহিঙ্গাদের পর্দার সামনেরটা দেখি। অন্তরালের গল্প শুনলে পিলে চমকে উঠার মতো কাহিনীও রয়েছে রোহিঙ্গাদের। তাদের মধ্যে একটি অংশ ভয়ঙ্কর। রোহিঙ্গারা প্রথমে তাদের অসহায়ত্বের কথা বলে আশ্রয় খুঁজে। স্থান পাবার পর তাদের পুরোনো নেতাদের (এনআইডিধারী) সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে বিভিন্ন উগ্রবাদী সংগঠনে যোগ দেয়। বাংলাদেশে পা রাখতে পারলেই দাবি করে থাকে তারা বাংলাদেশি।
এই রোহিঙ্গারা খোলস পাল্টাতে পারে যখন তখন। আরএসও, আলইয়াকিন নামে সন্ত্রাসীরা রোহিঙ্গা ক্যাম্পে চাঁদাবাজি ইয়াবা, অস্ত্র মজুত চোরাচালান ও আধিপত্যবিস্তারকে কেন্দ্র করে শতাধিক রোহিঙ্গা ও অন্তত ১৮ জন বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিভিন্ন সময় অভিযান চালিয়ে বহু অস্ত্র উদ্ধার ও রোহিঙ্গা ডাকাতদের গ্রেপ্তার করেছে। কক্সবাজার, রামু, উখিয়া, টেকনাফ, মহেশখালী ও সাতকানিয়াতে গড়ে তোলা হয়েছে মাদরাসা ও এতিমখানার নামে বহু রোহিঙ্গা প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান। যদিও দ্বীনি শিক্ষার নামে শিক্ষার্থীদের ভর্তি করা হয়ে থাকে, তবে রাতে রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন গেরিলা প্রশিক্ষণ দেয়া হয় বলে অভিযোগ রয়েছে।
ওইসব মাদরাসায় বেশিরভাগই এনআইডিধারী রোহিঙ্গা শিক্ষক ও আশ্রয় ক্যাম্পের বাইরে অভ্যন্তরে থাকা রোহিঙ্গা ছাত্র। স¤প্রতি ঢাকায় গ্রেপ্তার হওয়া আনসার আল ইসলাম সদস্য মারুফ চৌধুরী মিশু ওরফে ফারহানের সঙ্গে কক্সবাজারের বিভিন্নস্থানে প্রতিষ্ঠিত রোহিঙ্গা মাদরাসা প্রধান ও জাতীয় সনদধারী রোহিঙ্গা নেতা ইদ্রিছ জিহাদী, শায়খ ছালামত উল্লাহ, মৌলভি আয়াজ, মৌলভি শফিক (দাঁড়ি বিহীন) হাফেজ হাসিম, মৌলভি আবু ছালেহ, নূর হোসাইন, মাস্টার আয়ুব, এনায়েত, রুহুল আমিন, আবু সিদ্দিক, কামাল হোসেন, নুর কামাল, শামশুল আলম ও মৌলভি এমদাদের সঙ্গে যোগাযোগ ছিল বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
এ ঘটনার পর দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা ক্যাম্পের একাধিক মাঝি ও উল্লেখিত রোহিঙ্গা জঙ্গিগোষ্ঠী গা-ঢাকা দিয়েছিল। এসব অপরাধীচক্র আবারো মাথাচাড়া দিয়ে উঠার চেষ্টা করছে বলে গোয়েন্দা তথ্যে বলা হয়েছে।এদিকে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার রফিকুল ইসলাম বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেকোনো ধরনের অপতৎপরতা দমনে পুলিশ সক্রিয় রয়েছে।
পুলিশের পাশাপাশি অন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনও সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। যে কোনো ধরনের নাশকতা প্রতিহত করার সক্ষমতা নিয়ে যৌথ বাহিনী শুধু রোহিঙ্গা ক্যাম্প নয়, পুরো কক্সবাজারকে নজরদারীতে রাখা হয়েছে। এদিকে ৮ এপিবিএন-এর অধিনায়ক (এডিশনাল ডিআইজি) আমীর জাফর বলেন, রোহিঙ্গা ক্যাম্পের ভেতরে জঙ্গি সন্ত্রাসীরা নানা অপতৎপরতায় লিপ্ত থাকার খবর পেয়ে আমরা অপারেশন রোড আউট শুরু করেছি। রোহিঙ্গাদের সকল মাদরাসা এবং মসজিদে বাড়ানো হয়েছে নজরদারী।
গত এক মাসে দুই শতাধিক দুষ্কৃতকারীকে আটক করা হয়েছে। অভিযান অব্যাহত আছে।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য