-->
শিরোনাম

জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে অন্ধকার ইতিহাসের সাক্ষী ‘নীলকুঠি’

মাদারীপুর প্রতিনিধি
জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে অন্ধকার ইতিহাসের সাক্ষী ‘নীলকুঠি’
মাদারীপুর সদর উপজেলা ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামের নীলকুঠি চুল্লির চিমনি

কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে মাদারীপুর সদর উপজেলা ছিলারচর ইউনিয়নের আউলিয়াপুর গ্রামের নীলকুঠির। যেটি দেখলেই মনে পড়ে যায় নীল চাষের জন্য ব্রিটিশ শাসনামলে কৃষকদের ওপর ইংরেজদের নির্মম নির্যাতনের কথা। কিন্তু সংস্কারের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় পড়ে আছে ২৫০ বছরের পুরোনো এই নীলকুঠির। সংরক্ষণের অভাবে এখন আর টিকে নেই অবকাঠামো।

 

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ইংরেজরা ২৫০ বছর আগে দক্ষিণের জেলা মাদারীপুরে নীল চাষের জন্য ‘নীলকুঠির’ নামে একটি খামার স্থাপন করেছিল। নীলকুঠির ছাড়াও মাদারীপুরে পুরাকীর্তি হিসেবে রয়েছে, আলগী কাজী বাড়ি মসজিদ, রাজা রাম মন্দির, ঝাউদি গিরি, আউলিয়াপুর নীলকুঠি, বাজিতপুরের প্রণব মঠ, খালিয়া শান্তিকেন্দ্র, পর্বতের বাগান, শকুনী লেক। তবে এসব দর্শনীয় স্থানও সংরক্ষণের কোনো উদ্যোগ নেই।

 

১৮০০ সালে আউলিয়াপুর গ্রামে নীল চাষের একটি বৃহৎ খামার স্থাপন করে ইংরেজরা। ১৮৪৭-৪৮ সালে ক্ষতিগ্রস্ত হলে নীল চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয় কৃষকরা। তখন ইংরেজদের জুলুম ও নির্যাতনের শিকার হন তারা।

 

কৃষকদের আপত্তির পরও তাদের ওপর নির্যাতন চালিয়ে কৃষকদের বাধ্য করা হতো নীল চাষে। এই আউলিয়াপুর গ্রামটি মাদারীপুর সদর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার পূর্ব দিকে অবস্থিত। ধ্বংস হয়ে যাওয়া নীলকুঠি অভিশপ্ত হলেও মানুষের কাছে এটিকে ঘিরে নানা কৌতূহল রয়েছে।

 

এখনো এই গ্রামে রয়েছে খ্যাতিমান আউলিয়া হযরত শাহ সুফী খাজা ইউসুফ শাহ আহসানের দরগা শরিফ। অযতœ অবহেলায় এই দরগা শরিফটি আজ জরাজীর্ণ। দরগা শরিফটির অবস্থান নীলকুঠির পাশেই। স্বাধীনতার আগে অর্থাৎ ৬০ থেকে ৭০ বছর পূর্বেও এলাকাটি ছিল ঘন বনজঙ্গলে আবৃত। অবশ্য এখন এখানে আর জঙ্গল নেই। নীলকুঠির জমি বিভিন্ন লোক বিভিন্নভাবে দখল করে নিয়েছে। গড়ে তুলেছে ঘরবাড়ি। স্মৃতি হিসেবে রয়েছে শুধু চুল্লির চিমনি। তাও প্রায় ধ্বংসের পথে।

 

তবে যে জমিতে নীল চাষ করা হয় সে জমিতে ধান-পাট বা অন্য কোনো ফসল ফলে না বলেই কৃষকরা বাধা দিয়েছিল। বর্তমানে বিলুপ্ত ডানলপ সাহেবের নীলকুঠির পূর্ব দিকে রণখোলা, পশ্চিমে আউলিয়াপুর বাজার, উত্তরে কালীতলা ও দক্ষিণে আউলিয়াপুর দরগা শরিফ। ১২ কক্ষ বিশিষ্ট এই কুঠির মাঝামাঝি অংশে রয়েছে চুল্লি, যেখানে নীল তৈরি করা হতো।

 

চুল্লির পাশেই রয়েছে প্রায় ৪০ ফুট উঁচু একটি চিমনি। ইংরেজ ও জমিদারদের হাত থেকে কৃষকদের রক্ষা করাই ছিল নীল বিদ্রোহে হাজী শরীয়তউল্লাহর উদ্দেশ্য। পাশাপাশি সমাজে সব অনৈসলামিক কর্মকাÐের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন সোচ্চার।

 

পরবর্তীতে শরীয়তপুর জেলা তারই নামে নামকরণ করা হয়েছে। ১৮৪০ সালের ১৮ জানুয়ারি হাজী শরীয়তউল্লাহ মৃত্যুবরণ করলে তার অসমাপ্ত কাজ সম্পন্ন করার দায়িত্ব তার পুত্র পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়ার ওপর বর্তায়। হাজী শরীয়তউল্লাহ মৃত্যুর পর ফরায়েজী নেতা ও অনুসারীরা পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়াকে ফরায়েজি আন্দোলনের নেতা নির্বাচিত করেন।

 

তখন থেকেই শুরু হয় তার সংগ্রামী জীবন। অন্যায় অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে ফরায়েজিদের নিয়ে গড়ে তোলেন এক বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী।

 

১৮৪৫ সালের ৫ ডিসেম্বর পীর মহসিনউদ্দিন দুদু মিয়ার নেতৃত্বে তার বিশাল লাঠিয়াল বাহিনী আউলিয়াপুর ডানলপ সাহেবের নীলকুঠি আক্রমণ করেন।

 

৯০ বছর বয়সের সিরাজ ফরায়েজি বলেন, তখন এ আক্রমণের সংবাদ পেয়ে নীল কুঠিয়াল বাহিনীর একটি অংশ পালিয়ে যায়। ওইদিন রণখোলা নামক স্থানে দুপক্ষের মধ্যে তুমুল যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ডানলপ বাহিনী পরাজিত হয়। জুলুমের শিকার হতে কৃষকদের রক্ষা করে।

 

এই দীর্ঘ আন্দোলনের ফলে নীলচাষ বন্ধ হয়ে যায়। তখন ফরায়েজি আন্দোলনে নেতা হাজী শরীয়ত উল্লাহর অনুসারীদের আন্দোলনের মুখে পালিয়ে যায় নীলকররা। সেই নীলখামার থেকে নীলকুঠির নামের উৎপত্তি হয়। তবে এখনো দাঁড়িয়ে আছে সেই পুরোনো চুল্লির একটি চিমনি। যা ব্রিটিশ আমলের অত্যাচারের স্মৃতি বহন করে।

 

পরবর্তী প্রজন্ম জানতে পারে ১৮০০ সালে জেলা শহরের অদূরে আউলিয়াপুর নীল চাষ হতো। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশের তৈরি নীলকুঠিটি সংরক্ষণের দাবি জানান স্থানীয়রা।

 

স্থানীয় বাসিন্দা বৃদ্ধা ফিরোজা খাতুন (৬০) বলেন, আমি আমার শ্বশুর-শাশুড়ির থেকে শুনেছি, এখানে ইংরেজ ডানলপ সাহেবরা নীল তৈরির কারখানা করেছে। কৃষকরা তার এই নীল তৈরি করার কারখানায় কাজ করতে রাজি না হলেই তারা কৃষকদের মারত। কাজ না করলে তাদের ঘরের বাচ্চা-কাচ্চাসহ পরিবারের সবাইকে মারত। এভাবে কাজ করতে বাধ্য করত। তাদের তৈরি চিমনি দেখতে অনেক লোক এখানে আসে। এটি যদি সরকারিভাবে পরিষ্কার করা হয় তাহলে আরো লোকজন এসে দেখে বিষয়টা বুঝতে পারত যে, এখানে আগে কৃষকদের কত অত্যাচার করছিল ইংরেজরা।

 

মহামুদপুর ইউনিয়নের ২নং ওয়ার্ডের ইউপি সদস্য শাজাহান ঢালি বলেন, এই পুরোনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা দরকার। আর না হলে মানুষ কীভাবে বুঝবে এখানে ইংরেজরা নীল চাষ করত আর নীল চাষ করার জন্য কৃষকদের বাধ্য করত। সেই ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য সরকারের পদক্ষেপ নেয়া উচিত।

 

ছিলারচর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান তৌফিক আকন বলেন, এই পুরনো ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য এটি সংস্কার করা দরকার। এ দর্শনীয় স্থানটিকে দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে লোক আসে। এটি দেখার একটি ঐতিহাসিক বিষয়। যদি ওইভাবে রক্ষণাবেক্ষণ না করা হয় তাহলে ইতিহাস থেকে ঐতিহ্য হারিয়ে যাবে। তাই আমি সরকারের কাছে জোর দাবি জানাচ্ছি সংস্কারের।

 

সংস্কারের বিষয়ে মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ডক্টর রহিমা খাতুন বলেন, আমি সরেজমিনে গিয়ে দেখেছি এবং পর্যটক মন্ত্রণালয়ে কথা বলেছি। দেখা যাক কর্তৃপক্ষ কী সিদ্ধান্ত নেয়। তাদের সিদ্ধান্ত মোতাবেক দ্রুত আমরা সংস্কারের কাজ শুরু করব।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version