এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার: কক্সবাজারের উখিয়ায় পাহাড় কাটা ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বালু উত্তোলনের নামে বিলীন হয়েছে ৩০টি পাহাড়। বালুখেকোদের থাবার হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না এসব পাহাড়। বালুখেকোরা পাহাড়ের ওপর মেশিনের সাহায্যে পাইপ বসিয়ে উত্তোলন করছে বালু ও মাটি।
স্থানীয়রা বলছেন, দিনের বেলায় অভিযান চললে রাতের আঁধারে কাটে পাহাড়। ফলে প্রাণ প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের পাশাপাশি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাচ্ছে পাহাড়। ধ্বংস হচ্ছে বনাঞ্চল। পাহাড়খেকোদের থাবায়, খাদ্যের অভাবে মারা পড়ছে হাতিসহ নানা পশুপাখি।
একটি বেসরকারি সংস্থার জরিপ রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ২ বছরে বালুখেকোরা ৩০টি পাহাড়ের অন্তত ১ হাজার ৩০০ একর পাহাড়ি জমির শ্রেণি পরিবর্তন করেছেন। এতে হাজার কোটি টাকার বন সম্পদের ক্ষতি সাধিত হয়েছে। যে ক্ষতির জন্য দায়ী খালের বালির বৈধ ইজারা বা লিজ গ্রহীতা অবৈধভাবে পাহাড় কর্তনকারী সিন্ডিকেট।
উখিয়ার পালংখালী ও থাইংখালিতে ৫০-৬০টি স্পটে সংরক্ষিত বনাঞ্চলের ৩০টি পাহাড়ে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ চালাচ্ছে বালুখেকো সিন্ডিকেট। প্রতিবাদ করায় ইউপি চেয়ারম্যান এম গফুর উদ্দীন চৌধুরীসহ সাতজনের বিরুদ্ধে চাঁদাবাজি মামলা করেছে শক্তিশালী বালু সিন্ডিকেট। এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে চরম উত্তেজনা বিরাজ করছে। এলাকায় চলছে মানববন্ধন, বিক্ষোভ ও প্রতিবাদ। তারপরও বেপরোয়া বালুখেকোরা। কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না পাহাড় কাটা। এলাকাবাসী জানতে চায়, এদের খুঁটির জোড় কোথায়। গত ৯ ডিসেম্বর পাহাড কেটে বালু উত্তোলন করা ১০ হাজার ফুট পাহাড়ি বালু জব্দ করেছে বন বিভাগ।
এক বছরে বন বিভাগ ৬১টি বালু ও মাটিভর্তি ট্রাক ডাম্পার, শতাধিক ড্রেজার মেশিন, দুই শতাধিক বেলচা, কোদালসহ মাটি বালি কাটার যন্ত্রপাতি জব্দ করেছে। পাহাড় কেটে বালি ও মাটি পরিবহনের দায়ে ২১৮টি মামলায় আসামি করা হয়েছে ৪৩৫ জনকে।
সংঘবদ্ধ পাহাড়খেকোরা ওই এলাকায় সশস্ত্র পাহারা এবং সিসি ক্যামেরা বসিয়ে দীর্ঘদিন একের পর এক সরকারি পাহাড় কেটে বালু ও মাটি বিক্রির জন্য স্তূপ করছিল। ওই বালুগুলো সম্প্রতি জব্দ করে বন বিভাগ। বালু ইজারার নামে একের পর এক পাহাড় গিলে খাচ্ছে তারা।
সরেজমিন দেখা যায়, খাল বা ছড়ায় ড্রেজার মেশিন বসিয়ে পাইপ দিয়ে পাহাড়ের ওপর পানি তুলে মাটি আর পানি গুলিয়ে শরবত বানিয়ে মেশিনের সাহায্যে বালি উত্তোলন করছে তারা। শক্তিশালী এই সিন্ডকেটকে মামলা, জরিমানা, মোবাইল কোর্ট বসিয়ে মালামাল জব্দ করেও ঠেকানো যাচ্ছে না। জনৈক আলী আহমদের নেতৃত্বে চলছে পালংখালী ও টাইংখালীতে পাহাড় কাটার মহোৎসব।
ইজারার সীমানার বাইরে গিয়ে পাহাড় খুঁড়ে বের করছে হাজার হাজার ফুট বালু ও মাটি। টাইংখালী ও পালংখালী বিট কর্মকর্তাদ্বয় এ প্রতিবেদককে জানান, বালুখেকোরা খুবই হিংস্র। তারা সশস্ত্র অবস্থায় এসব অপরাধ করে যাচ্ছে। এমনকি তারা রোহিঙ্গা সন্ত্রাসীদের পাহাড় কেটে বালু উত্তোলনে ব্যবহার করছে বলে জানিয়েছেন পালংখালী ইউনিয়ন পরিষদের ৬ জন সদস্য। শুধু তাই নয়, এসব বালুখেকোদের বিরুদ্ধে পাহাড় কাটা বন্ধের দাবিতে একাধিকবার মানববন্ধন, বিক্ষোভ মিছিল ও প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে এলাকাবাসী।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) কক্সবাজার জেলার সভাপতি ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক কলিম উল্লাহ বলেন, পাহাড় কাটার ভয়াবহতা বন্ধ করা না গেলে নিচিহ্ন হয়ে যেতে পারে অর্ধশতাধিক পাহাড়। এতে পরিবেশ বিপর্যয়সহ পাহাড় ধসের আশঙ্কাও করছে পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো।
উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান হোছাইন সজীব জানান, বালু ইজারাদার ক্ষমতার অপব্যবহার করে সরকারি সংরক্ষিত পাহাড়ের মাটি কর্তন করছে। অভিযান চালিয়ে বালু ও মাটিভর্তি ডাম্পার আটক করা হয় বারবার। তারা রাতের বেলায় মাটি ও বালি পরিবহন করে যা ইজারা বা লিজ আইনের পরিপন্থি। সিন্ডিকেট সদস্যরা ইজারা বা লিজ নেয়ার কোনো কাগজপত্র দেখাতে এ সময় ব্যর্থ হন। উখিয়ার পালংখালীর থাইনখালী ও মুছারখোলা বনবিট এলাকায় পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর অভিযান চালিয়েছে বন বিভাগ। এ সময় স্তূপকৃত বালু, মাটি ও একটি ডাম্পার গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। তবে পাহাড় কাটার সঙ্গে জড়িত কেউ আটক হয়নি। আগামীতে বন বিভাগ উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ মিলে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করা হবে। পাহাড়, প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষায় সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
জানা গেছে, গত শনিবার বন বিভাগের এক অভিযানে ওই বিপুল পরিমাণ বালু ও মাটি জব্ধ করে উখিয়া বন বিভাগ।
কক্সবাজার সিভিল সোসাইটির সভাপতি আবু মোর্শেদ চৌধুরী বলেন, এই ভয়াবহ পাহাড়খেকোদের বিরুদ্ধে কেন পরিবেশ অধিদপ্তর মামলা করছে না, তা নিয়ে সচেতন মহলে নানা প্রশ্ন দেখা দিয়েছে।
কক্সবাজার উত্তর বন বিভাগের বিভাগীয় কর্মকর্তা মো. সারোয়ার আলম বলেন, ‘অবৈধভাবে পাহাড় কাটা বন্ধে গত শনিবারও অভিযান চালানো হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে। এতে জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থাও নেয়া হচ্ছে।
কক্সবাজার দক্ষিণ বন বিভাগের উখিয়া বন কর্মকর্তা গাজি শফিউল আলম বলেন, পাহাড় কাটার পয়েন্টগুলোতে লাল পতাকা টানিয়ে দেয়া হয়। এ রকম ১০টি পয়েন্টে পাওয়া গেছে পাহাড় কাটা কয়েক কোটি টাকার মাটি ও বালু।কতটি পাহাড় কাটা হয়েছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কোনো চিহ্ন না থাকায় সঠিকভাবে বলা মুশকিল। পাহাড়ের কাটা মাটিতে লবণ মিশিয়ে দেয়া হয়েছে। লবণ মিশানো মাটি এবং বালু অন্যত্র ব্যবহার করা যায় না। এ কারণেই তা করা হয়েছে। পাহাড় কাটায় নিয়োজিত লোকজনের বিরুদ্ধে অতি সম্প্রতি ১৮টি মামলাও করা হয়েছে। যাদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তারা সবাই পাহাড় নিধনের ঘটনায় জড়িত স্থানীয় লোকজন। এদের সঙ্গে রয়েছে সশস্ত্র ভাড়াটে রোহিঙ্গাও।
বন কর্মকর্তা আরো বলেন, সংঘবদ্ধ এসব ব্যক্তি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাহারা বসিয়ে এবং সিসি ক্যামেরার সাহায্যে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার লোকজনের গতিবিধি নজরে রেখে দীর্ঘদিন ধরে এমন অপকর্ম করে আসছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, এই পাহাড়খেকোদের পেছনে একটি শক্তিশালী চক্র জড়িত রয়েছে। স্থানীয়দের দাবি, পাহাড়খেকো সিন্ডিকেটের বিরুদ্ধে জোরালো আইনি ব্যবস্থা নেয়া হোক। কক্সবাজার জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান শাহীনুল হক মার্শালের নাম ভাঙিয়ে পাহাড় কেটে বালু উত্তোলনের অভিযোগ রয়েছে।
তবে জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান বলেন, খালের নির্ধারিত ইজারাকৃত বালু মহালের বালু উত্তোলনের বাইরে কেউ পাহাড় কাটলে এর দায়ভার আমি নিতে পারি না।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য