মাটির ঘরের টিনের ছাউনি, দরজার সামনে চৌকাঠে মাথায় হাত দিয়ে বসে আছেন একই দিন দুই সন্তানহারা অসহায় বাবা জহির আহমদ। তার দু’পাশে বসে আছে নিহত জালাল ও কামালের ছোট চার ভাই। ঘরের ছাউনি-বেড়া ছেদ করে সূর্যের আলো পড়ে ঘরের ভেতরে। দিন এনে দিন খাওয়া এই অসহায় পরিবারে মা-বাবার ছিল ছয় সন্তান।
হঠাৎ অনাকাঙ্খিত এক তুচ্ছ ঘটনায় হারিয়েছে বড় দুই ছেলেকে। যারা বৃদ্ধ মা-বাবার সংসারের দু’মুঠো ডাল-ভাতের জোগান দিতেন। দু’টি গরু ও কয়েকটি ছাগল লালন-পালনের পাশাপাশি কৃষি জমিতে ফসল ফলিয়ে দিন পার করতেন বাবা জহির আহমদ।
বড় ছেলে বাইক রাইড ও অন্য ছেলে দিনমজুরের কাজ করে যে’কয় টাকা আয় করতো তা দিয়েই সংসার চালিয়ে নিতেন মা সুলতানা বেগম। কিন্তু গত রাত থেকেই মুখে কোনো কথা নেই এই মায়ের। দুই ছেলেকে কবর দিয়ে এসে এভাবেই দরজার চৌকাঠে বসে আছেন বাবা জহির আহমদ ও মা সুলতানা বেগম।
গত শনিবার সরেজমিনে দেখা যায়, বোবাকান্নায় ভেঙে পড়েছেন তারা। কিছুক্ষণ পর পর বিলাপ করে বলেন ওঠেন নির্মম এই হত্যাকান্ড ও অসহায়ত্বের কথা। জানতে চান দুই ছেলেকে তাদের কোলে ফিরিয়ে দিতে পারব কি-না। মায়ের একটাই কথা, ছেলেকে ফিরে পাবেন সেই আশা নিয়ে বোবা হয়ে আছেন, কাউকে কিছুই বলবেন না তিনি। যতক্ষণ ছেলেরা ফিরে আসবে না।
তবে বাবা জহির আহমদ ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে বলেন, আমরা এখন নিঃস্ব হয়ে গেছি। পরিকল্পিতভাবে আমার দুইটা ছেলেকে ডেকে নিয়ে নির্মমভাবে তারা হত্যা করেছে। কিভাবে পারলো এমন নিষ্ঠুরতার পরিচয় দিতে। আমাকে হত্যা করলেও কেউ আফসোস করতো না। কিন্তু আমার দুইটা ছেলেকে কবরে পাঠিয়ে দিয়েছে তারা। আমি তাদের ফাঁসি ছাড়া আর কিছুই কামনা করতে পারছি না। সরকার যেন তাদের ফাঁসি দেন। এদিকে সন্তানদের হারিয়ে মা-বাবা পাগল প্রায়। তাদের কথা মনে পড়লেই জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন মা সুলতানা বেগম।
চার সন্তানকে আগলে রেখে নিহত দুই ছেলের মৃত্যুর শোকে কাতর হয়ে বিলাপ করে কাঁদেন বাবা। কপালে চিন্তার ভাজ, মাথায় হাত। গত শুক্রবার বিকাল ৪ টার সময় গরুর রশি চুরিকে কেন্দ্র করে বাকবিতÐার জেরে প্রতিপক্ষের ছুরির আঘাতে ঘটনাস্থলে মারা যায় জহির আহমদের দুই ছেলে জালাল (২২) ও কামাল (১৮)। রাতে নিহতের বাবা জহির আহমদ বাদি হয়ে ৪ জনের নামে এজাহার দিয়ে ও ২ জন অজ্ঞাতনামা করে হত্যা মামলা দায়ের করেন দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানায়।
মামলায় আসামিরা হলেন, শফিকুল ইসলাম ও তার তিন সন্তান সাইফুল ইসলাম, খোরশেদ আলম এবং মোরশেদ আলম। তারা উপজেলার পদুয়া ইউনিয়নের ৬ নম্বর ওয়ার্ড পশ্চিম খুরুশিয়া মধ্য পাড়া এলাকার বাসিন্দা। মামলার প্রধান আসামি খোরাশেদ ও তার বাবা শফিকুল ইসলামকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে ছুরি চালানো মোরশেদ ও সাইফুল ইসলাম ঘটনার পর থেকে পলাতক রয়েছে।
অন্যদিকে হত্যাকান্ডের শিকার দুই ভাই জালাল ও কামাল একই এলাকার ঠান্ডা মিয়ে সংদাগর বাড়ির জহির আহমদের ছেলে।
এদিকে নিহত জালালের ঘরে ৮ মাসের এক কন্যা সন্তান রয়েছে। সোনালী শৈশব কাটিয়ে বাবা ডাকার আগেই হয়েছেন পিতা হারা, স্ত্রী হয়েছে বিধবা। তবে মেয়ে ইসরাত এখনও জানেনা তার বাবা মারা গেছে। এই ঘটনার পর তছনছ হয়ে গেছে তাদের পরিবার।
পরিবারের দেওয়া তথ্যমতে, শুক্রবার সকালে তাদের ফসল নষ্ট করেছে বলে জানায় প্রতিপক্ষ শফিকুল ইসলামকে। পরে গরুর রশি চুরি করেছে তকমা নিয়ে বাকবিতÐা হয়। তবে সালিসি বৈঠকের মাধ্যমে সেখানেই সেটির সমাধান হয়। পরে জালাল ও কামাল বাড়িতে চলে যায়। কিন্তু জুমার নামাজ শেষে বিকাল ৪ টায় জালাল ও কামালকে প্রতিপক্ষ শফিকুল ইসলামের ছেলে মোরশেদ ফোন করে ডেকে হামলা শুরু করে। এ সময় তার বাবা ও ছেলেরা তাদের এলোপাতাড়ি কুপিয়ে যখম করে। একপর্যায়ে মোরশেদ ছুরি দিয়ে বুকে আঘাত করে জালাল ও কামালের মৃত্যু নিশ্চিত করে।
তাদের বাঁচাতে গিয়ে পাশ্ববর্তী আরও তিনজন মোরশেদের ছুরির আঘাতে আহত হয়। তারা বর্তমানে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে (চমেক) চিকিসাধীন রয়েছে। তবে একজনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলেও জানান তারা।এদিকে হত্যাকান্ডের পরপর দু’জনকে গ্রেফতার করে পুলিশ। তবে হত্যাকান্ডে ছুরি চালানো অপর আসামি মোরাশেদ ও সাইফুল পলাতক থাকায় অস্বস্তি দেখা দিয়েছে নিহত জালাল ও কামালের পিতা জহির আহমদের মাঝে। স্থানীয়দের দেওয়া তথ্যমতে, এলাকায় বিভিন্ন অপরাদমূলক কর্মকাÐে নাম রয়েছে পলাতক মোরশেদের।
মোরশেদ ও তার সহযোগী সাইফুল ইসলামকে দ্রæত গ্রেফতারের দাবি জানান এলাকাবাসী। এ বিষয়ে দক্ষিণ রাঙ্গুনিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ওবায়দুল ইসলাম বলেন, তুচ্ছ ঘটনাকে কেন্দ্র করেই হত্যাকান্ডের মতো ঘটনা ঘটেছে। সাথে সাথে ঘটনাস্থলে গিয়ে অভিযুক্ত দুই আসামি শফিকুল ইসলাম ও তার ছেলে খুরশেদকে গ্রেফতার করি। তাদের শনিবার সকালে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়। অন্যান্য পলাতক মোরশেদ ও সাইফুলকে ধরতে কাজ করছে পুলিশ।
উল্লেখ্য, শুক্রবার বিকাল ৪ টায় গরুর রশি ও খুঁটি চুরি করাকে কেন্দ্র করে প্রতিপক্ষের চুরির আঘাতে নিহত হয় জালাল ও কামাল নামের দুই ভাই।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য