এইচ এম ফরিদুল আলম শাহীন, কক্সবাজার: জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পুরস্কারপ্রাপ্ত কক্সবাজারের মুক্তিযোদ্ধা আমান উল্লাহ। ৮ বছর ধরে তার নাম নেই মুক্তিযোদ্ধার তালিকায়। ২০১৪ সালে মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা হালনাগাদের সময় আমান উল্লাহর নাম কাটা পড়ে।
আমান উল্লাহ বলেন, মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদান রাখায় ১৯৭২ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে নগদ এক হাজার টাকা পুরস্কার প্রদান করেন। পুলিশের চাকরির প্রস্তাবও দেন বঙ্গবন্ধু। কিন্তু আমি লেখাপড়া তেমন করিনি বলে সেই প্রস্তাব ফিরিয়ে দিই। তারও আগে কক্সবাজার মহকুমা ট্রেজারি রক্ষা করায় আমাকে রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে তৎকালীন সময়ে ২৫০ টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। সেই আমি দীর্ঘ ৮ বছর ধরে মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করতে দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়াচ্ছি।
এভাবেই নিজের মনের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ করেছেন, ৮০ বছর বয়সি কক্সবাজারের ঈদগাঁও উপজেলার পোকখালী ইউনিয়নের পূর্ব পোকখালী গ্রামের মৃত আহামদ মিয়ার ছেলে বীর মুক্তিযোদ্ধা আনসার কমান্ডার আমান উল্লাহ। আমান উল্লাহ বলেন, জীবন বাজি রেখে মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরে আনসার কমান্ডার হিসেবে বারবার সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি। ২৫ মার্চ বিকেলে হত্যা করেছি ১১ জন পাঞ্জাবিকে। দুই পুলিশের সঙ্গে থেকে এক সপ্তাহ মহকুমা ট্রেজারি রক্ষা করেছি।
তবুও আমার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নেই। আছে হাজারো ভুয়া মুক্তিযোদ্ধার নাম। আমি আমার ন্যায্য প্রাপ্যটুকু চাই শুধু। বাড়তি কোনো চাওয়া-পাওয়া আমার প্রয়োজন নেই। মুক্তিযুদ্ধের কথা উঠতেই বৃদ্ধ আমান উল্লাহর চোখ ছলছল করে উঠে।
আমান উল্লাহ বলেন, ২৫ মার্চ কালো রাতে যখন আমরা জানতে পারি পাকিস্তানি দোসররা আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করেছে, ঢাকায় নির্বিচারে মানুষ হত্যা করছে, তখন আমরা কক্সবাজারের ৫০ জন আনসার সদস্য শহরের বিমানবন্দর সড়কের ইপিআর ক্যাম্প (বর্তমান স্কাউট ভবন) ঘেরাও করি। সেখান থেকে ভোর রাতে ১১ জন পাঞ্জাবিকে আটক করি। পরে ১নং সেক্টরের মেজর শওকতের নির্দেশে তাদের রামুর পানের ছড়া ঢালায় নিয়ে হত্যা করি। এর কয়েকদিন পরে মরহুম বীর মুক্তিযোদ্ধা এ কে এম মোজাম্মেল হকের (মোজাম্মেল চেয়ারম্যান) নির্দেশে আমি ও আমার ১০ জন আনসার সদস্য চট্টগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের ১নং সেক্টরে যোগদান করি।
সেখানে মেজর শওকতের নেতৃত্বে প্রায় এক মাস যুদ্ধ করি। একটি সম্মুখযুদ্ধে ক্যাপ্টেন হারুন গুলিবিদ্ধ হলে তাকে নিয়ে আমরা চকরিয়া মালুমঘাট খ্রিস্টান মেমোরিয়াল হাসপাতালে আসি। সেখানে ক্যাপ্টেনের চিকিৎসা ব্যবস্থা করে আমরা সবাই ফাসিয়াখালি বন বিভাগের রেঞ্জ অফিসে (বর্তমান সেনাবাহিনী ক্যাম্প) আসি। ওখান থেকে আমরা কক্সবাজার ফিরে আসি। তখন তৎকালীন কক্সবাজার মহকুমা প্রশাসক মো. ছোলাইমান আমাকে জানায়, মহকুমা ট্রেজারি লুটপাট করার চেষ্টা চালাচ্ছে পাকিস্তানি দোসররা। আমি যেন এর নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকি। তার নির্দেশে আমি ও দুই পুলিশ সদস্য এক সপ্তাহ ট্রেজারি পাহারা দেই। এরপর যুদ্ধ শেষ হলে আমি আনসারের চাকরি ছেড়ে দিই। তখন থানা থেকে আমার গ্রামের বাড়িতে চিঠি পাঠানো হয়।
আমি থানায় আসলে আমাকে ২৫০ টাকা পুরস্কার দেয়া হয়। তার কিছুদিন পরে মরহুম মোজাম্মেল হক চেয়ারম্যান আমাকে নিয়ে ঢাকায় যায়। তখন বঙ্গবন্ধু আমার বীরত্বের কথা শুনে এক হাজার টাকা নগদ পুরস্কার দেন এবং চাকরির প্রস্তাব দেন। সেই থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত আমার নাম মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় ছিল। কিন্তু তালিকা হালনাগাদের সময় অসুস্থতার কারণে আমি উপস্থিত থাকতে না পারায় আমি তালিকা থেকে বাদ পড়ি। তখন থেকেই নানাভাবে চেষ্টা চালাচ্ছি প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধার তালিকায় নিজের নাম অন্তর্ভুক্ত করার। এজন্য মুক্তিযোদ্ধা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি। কিন্তু বারবার গায়েব হয়ে যাচ্ছে আমার আবেদন।
এ বিষয়ে চট্টগ্রামের কালুরঘাটের আমানের সঙ্গে যুদ্ধ করা বীর মুক্তিযোদ্ধা জালাল আহমদ (গেজেট নং ৪৯) বলেন, আমান উল্লাহ একজন প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা। তিনি আনসার কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছেন।কক্সবাজার জয় বাংলা বাহিনীর প্রধান ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার কামাল হোসেন চৌধুরী বলেন, আমান উল্লাহ যুদ্ধের সময় ১নং সেক্টরের নানা সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন।
এ বিষয়ে কক্সবাজার জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও জেলা মুক্তিযোদ্ধা যাচাই-বাছাই কমিটির সভাপতি মোস্তাক আহমদ চৌধুরী বলেন, আমানউল্লাহ একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে বিভিন্ন অপারেশনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। তার দলের কমান্ডার ছিলেন আবু তাহের। আমি তার নাম মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করেছি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য