ঢাকা-টাঙ্গাইল-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের এলেঙ্গা থেকে বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ১৩.৬ কিলোমিটার এলাকা ৪ লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের মাটি ভরাটের কাজ চলছে। মহাসড়ক উন্নীতকরণ ওই প্রকল্পে মাটি-বালু বিক্রি করে লাভবান হতে প্রভাবশালীদের যোগসাজশে হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা উপেক্ষা করে পাউবোর পুনরুদ্ধারকৃত ১৬৮ একর ভূমির অংশ কেটে নিউ ধলেশ্বরীর সমান্তরালে পৃথক কৃত্রিম নদী তৈরি করেছে স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা।
জানা গেছে, বুড়িগঙ্গা নদী খনন ও পুনরুদ্ধার (নিউ ধলেশ্বরী-পুংলী-বংশাই-তুরাগ-বুড়িগঙ্গা রিভার সিস্টেম) প্রকল্পের আওতায় নিউ ধলেশ^রী নদীর বাম তীরে কালিহাতী উপজেলার বিনোদ লুহুরিয়া, কুর্শাবেনু ও কদিমহামজানী মৌজার ১৬৮ একর ভূমি পুনরুদ্ধার করে পানি উন্নয়ন বোর্ড। ওই প্রকল্পে অবাধ পানি প্রবাহ সৃষ্টিতে পাউবো ওই এলাকায় আরো ৩৪.১৯ একর ভূমি অধিগ্রহণ করে। কিন্তু গত বর্ষায় নিউ ধলেশ্বরী নদীতে পলি জমে চর জেগে যাওয়ায় পাউবো ওই ভূমিতে ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছ রোপণের উদ্যোগ নেয়।
গত ২২ সেপ্টেম্বর বিনোদ লুহুরিয়া মৌজায় ঘটা করে পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কবির বিন আনোয়ার (বর্তমানে মন্ত্রী পরিষদ সচিব) পুনরুদ্ধারকৃত ভূমিতে গাছ লাগানো কর্মসূচির উদ্বোধন করেন। কিছু এলাকায় বিভিন্ন জাতের ২ হাজার ৮৬০টি ফলজ, বনজ ও ওষুধি গাছের চারা রোপন করা হয়। ওই সময় তিনি দখলকারীদের বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ‘অবৈধ দখলদারদের কোনো মূল্যে ছাড় দেয়া হবে না। দখলকারী হাজারি বা মনি যার লোকই হোন না কেন- অবৈধ হলে তাকে ছাড় দেয়া তো দূরের কথা, আইনের কাছে সোপর্দ করা হবে।’ এরই মধ্যে এলেঙ্গা-বঙ্গবন্ধু সেতু মহাসড়কের ১৩.৬ কিলোমিটার এলাকা চার লেনে উন্নীতকরণ প্রকল্পের কাজ শুরু হয়। মাটি-বালু না পেয়ে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের লোকজন স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও বালু ব্যবসায়ীদের স্মরণাপন্ন হয়। স্থানীয় বালু ব্যবসায়ীরা রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় পাউবোর পুনরুদ্ধার ও অধিগ্রহনকৃত ভূমি থেকে মহাসড়ক উন্নয়নে মাটি দেয়ার প্রয়াস পায়।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, স্থানীয় বালু ব্যবসায়ী জহুরুল ইসলাম, চান মিয়া, জাহাঙ্গীর আলম, আব্দুল বাছেদ, গোলজার হোসেন, ইউসুফ আলী, মাসুদ রানা ও নুরুল ইসলামের (মেম্বার) নেতৃত্বে কুর্শাবেনু ও কদিমহামজানী মৌজার নিউ ধলেশ্বরী নদীর তীরের মাটি-বালু কেটে সমান্তরাল একটি কৃত্রিম নদী সৃষ্টি করে ফেলেছে। ফলে নিউ ধলেশ্বরী নদীর মুখ (অফটেক) থেকে ডান ও বাম তীরের ১৯টি গ্রামে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙনের আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।
কুর্শাবেনু গ্রামের কামরুল, বেলাল হোসেন, কদিমহামজানীর নওশের আলী, শরীফুল, রিপনসহ আরো অনেকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, বালু ব্যবসায়ীরা অত্যন্ত প্রভাবশালী হওয়ায় তাদের বিরুদ্ধে কেউ কথা বলার সাহস পায় না। প্রতিবাদ করলে শারীরিকভাবে লাঞ্ছনাসহ নানা রকম হয়রানি ও মিথ্যা মামলায় আসামি করা হয়। মূলত বালু ব্যবসায়ীরা উন্নয়নের সঙ্গে কথা বলে বালু-মাটি উত্তোলন ও সরবরাহ করছে। এ কারণে প্রশাসনের পক্ষ থেকেও কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না। এছাড়া নদীর তীরের ওই স্থানগুলো দুর্গম হওয়ায় প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা সরেজমিন পরিদর্শনও করতে পারে না। তবে অধিকাংশ সময় প্রতিবাদকারীদের টাকার লোভ দেখিয়ে চুপ করিয়ে দেয়া হয়। যারা কথা না শোনে তাদের ভিন্ন পন্থায় শায়েস্তা করা হয়। এদিকে টাঙ্গাইল পাউবোর একটি সূত্র জানায়, ওই এলাকার ঘরে ঘরে বালু ব্যবসায়ী। তারা অধিকাংশ সময় পাউবোর ভূমি থেকে মাটি-বালু উত্তোলন করে থাকে। পাউবোর পক্ষ থেকে বার বার সতর্ক বাণী দেয়া হলেও তারা কর্ণপাত করে না। এছাড়া ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার জন্য জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে ম্যাজিস্ট্রেট চেয়েও সময়মতো বা প্রয়োজনের সময় পাওয়া যায় না। এজন্য বেশিরভাগ সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।
গোহালিয়াবাড়ী ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল হাই আকন্দ ও সল্লা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল আলীম জানান, নদী কেটে কেউ বালু-মাটি মহাসড়ক উন্নয়ন প্রকল্পে বিক্রি করছেন এমনটা তারা জানেন না। অনেকে নিলামকৃত বালু বিক্রি করেছেন। সেগুলো ড্রেজারের মাধ্যমে সরবরাহ করা হচ্ছে। নদীর তীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করলে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙন দেখা দেবে এটা নিশ্চিত। পাউবো কর্তৃক পুনরুদ্ধারকৃত ভূমি কেটে মাটি-বালু বিক্রি করছে এমন কোনো খবর তারা জানেন না।
এ ব্যাপারে টাঙ্গাইল পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, তিনি সবেমাত্র এখানে যোগদান করেছেন। তাই এ বিষয়ে কিছু জানেন না। পাউবোর সম্পত্তি রক্ষায় হাইকোর্টের নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। ওই সম্পত্তিতে মাটি-বালু কাটা সম্পূর্ণ অবৈধ। সাজ্জাদ হোসেন আরো জানান, কেউ দখল বা ভোগ দখল করলে সরেজমিন পরিদর্শন করে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। তিনি পাউবোর ওই এলাকার দায়িত্বপ্রাপ্ত উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. ইমদাদুল হককে ব্যবস্থা গ্রহণের প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিয়েছেন।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য