-->
শিরোনাম

বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করে নিজ বাসায় সাজিয়ে রেখেছেন তিনি

জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ
বধ্যভূমির মাটি সংগ্রহ করে নিজ বাসায় সাজিয়ে রেখেছেন তিনি
ভালুকায় নিজ বাসায় বধ্যভ‚মির মাটি এবং শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ করেছেন সেলিনা রশিদ

জাহাঙ্গীর আলম, ময়মনসিংহ: দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বধ্যভ‚মিতে বাবার অস্তিত্ব খুঁজে বেড়াচ্ছেন সেলিনা রশিদ। ২২০ বধ্যভূমির পবিত্র মাটি সংগ্রহ করে ময়মনসিংহের ভালুকায় নিজ বাসায় সাজিয়ে রেখেছেন তিনি। শ্রীপুর উপজেলার মাওনা ইউনিয়নের চকপাড়া গ্রামে তাঁর জন্ম। বাবা শহীদ বীর মুক্তিযোদ্ধা জহির উদ্দিন। মা আনোয়ারা বেগম। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে বাবা কর্মরত ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে। অন্য তিন বোনসহ মা-বাবার স্নেহ -ভালোবাসায় বেড়ে উঠছিলেন সেলিনা।

 

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জন্ম ভূমির টানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে বাড়ি ফিরে আসেন জহির উদ্দিন। কয়েক দিনের মধ্যেই সিদ্ধান্ত নেন মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেবেন। সেই মতে একদিন সকালে নিজ হাতে রান্না করে পরিবারের সবাইকে খাইয়ে স্ত্রী-সন্তানের মাথায় হাত বুলিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বাড়ি ছাড়েন তিনি। ওই সময় সেলিনার বয়স ছিল ৯ বছর। পড়তেন তৃতীয় শ্রেণিতে। ভয়ানক ওই সময় জহির উদ্দিন ৬ নম্বর সেক্টরের রংপুর এলাকায় মুক্তযুদ্ধ করেন। তাঁর গেজেট নম্বর ৯৯। বর্তমানে সন্তানরা বাবার মুক্তিযোদ্ধা ভাতা পাচ্ছেন।

 

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর যুদ্ধে যাওয়া অনেকের সন্তান, বাবা, ভাই ফিরে এলেও সেলিনার বাবা জহির উদ্দিন ফেরেননি। তাঁর জন্য শুরু হয় স্ত্রী-সন্তানদের অপেক্ষার পালা। মাস গড়িয়ে বছর, এভাবে ৫০ বছর পার হলেও আর ফেরেননি জহির উদ্দিন।

 

জহির উদ্দিনের অবর্তমানে তাঁর স্ত্রী-সন্তানদের ওপর নেমে আসে স্বজনদের নির্যাতন। জোর করে তাঁদের উত্তরাধিকারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়। নির্মম-নিষ্ঠুরতায় কাটতে থাকে সেলিনার পরিবারের দিনগুলো। এর মধ্যেও কষ্ট করে সেলিনারা তিন বোন লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৯৭৯ সালে এসএসসি পাসের পর ১৯৮০ সালে ভালুকার আবদুর রশিদের সঙ্গে সেলিনার বিয়ে হয়।

 

বিয়ের পর তিনি এইচএসসি, ডিগ্রি, এমএ, এমবিএ ও পিএইচডি অর্জন করেন। কিন্তু প্রতি মুহূর্তে তাঁকে তাড়িয়ে বেড়ায় বাবার স্মৃতি। কতজনের বাবাই তো যুদ্ধ শেষে স্বাধীন দেশে ফিরে এসেছেন। অথচ তাঁর বাবা ফিরলেন না। সেই থেকে তিনি শুরু করেন বাবাকে খোঁজা। বছরের পর বছর ধরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের বধ্যভূমি গুলোতে যেতে শুরু করেন। পরম মমতায় সংগ্রহ করতে শুরু করেন বধ্যভূমির পবিত্র মাটি। হয়তো এসব বধ্যভূমির কোনো একটির পবিত্র মাটিতে শুয়ে আছেন বাবা।

 

এভাবে গত ১১ বছরে দেশের বিভিন্ন প্রান্তের ২২০টি বধ্যভ‚মি থেকে পবিত্র মাটি সংগ্রহ করেছেন সেলিনা রশিদ।

 

পবিত্র এই মাটি সংরক্ষণের জন্য ময়মনসিংহের ভালুকায় নিজ বাসায় গড়ে তোলেন ‘জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযুদ্ধ সংগ্রহশালা’। সেখানে ২২০টি বধ্যভ‚মি থেকে সংগ্রহ করা পবিত্র মাটি সংরক্ষণ করেছেন। পাশাপাশি তাঁর সংগ্রহশালায় সংরক্ষণ করা হয়েছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সমাধি পারের মাটি, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের কবরের মাটি, ভাষাশহীদ, ভাষাসৈনিক এবং জাতীয় চার নেতার কবর পারের মাটি। এখনো কোনো বধ্যভূমির খবর পেলে সেখানে ছুটে যান সেলিনা।

 

সংগ্রহ করেন সেখানকার পবিত্র মাটি। বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবস, ২১শে ফেব্রুয়ারি সংগ্রহ করা এসব স্মৃতিচিহ্নে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরই মধ্যে বর্তমান সরকারের বেশ কয়েকজন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী তাঁর সংগ্রহশালা পরিদর্শন করেছেন।

 

শহীদ সন্তান ৭১এর কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, ভালুকা উপজেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান সেলিনা রশিদ বলেন, ‘সরকারের কাছে আমার দাবি, যেসব শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ পাওয়া যায়নি, তাঁদের জন্য এলাকাভিত্তিক একটি করে প্রতীকী কবর স্থাপন করা হোক।’

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version