-->
শিরোনাম

শুঁটকি ব্যবসায় বদলে গেল সাগরপাড়ের মানুষের জীবন

স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার
শুঁটকি ব্যবসায় বদলে গেল সাগরপাড়ের মানুষের জীবন
কক্সবাজার সাগরপাড়ের একটি শুঁটকি পল্লী

শুঁটকি ব্যবসা করে কক্সবাজারের সাগরপাড়ের অনেক মানুষের জীবনে এসেছে সমৃদ্ধি, দূর হয়েছে দারিদ্র। এদেরই একজন মনোয়ারা বেগম। সাত বছর আগে জীবিকার তাগিদে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান মনোয়ারা বেগমের স্বামী মো. নুর। স্বামী বেঁচে আছেন কি না জানা নেই স্ত্রীর।

 

এরই মধ্যে নদীভাঙনে টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়া থেকে বাস্তুহারা হয় পরিবারটি। সন্তানদের নিয়ে অন্যত্র আশ্রয় নিলেও কষ্টের শেষ ছিল না মনোয়ারার। দীর্ঘদিন কষ্টের পর প্রতিবেশী আমিনা খাতুনের পরামর্শে আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশনের (ইউপিজি) সদস্য হন।

 

২০২০ সালে ওই ইউপিজি থেকে অফেরতযোগ্য ২০ হাজার টাকার সহায়তায় নিয়ে সাগরপাড়ে শুঁটকি ব্যবসা শুরু করেন। এরই মধ্যে হয়ে ওঠেন স্বাবলম্বী। এখন তিনি শুঁটকি সওদাগর। দারিদ্র্যকে জয় করে বদলে গেছে তার জীবনযাত্রা।

 

শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ায় গিয়ে দেখা গেছে, শুধু মনোয়ারা নন; এই পাড়ার আরো কয়েকজন নারী বিভিন্ন ব্যবসা করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তারা সবাই ইউপিজির সহায়তায় ঘুরে দাঁড়িয়েছেন।

 

নিজের অতীত কষ্টের বর্ণনা দিয়ে মনোয়ারা বেগম বলেন, ‘জীবনে অনেক কষ্ট করেছি। দুই বেলা খাওনও জোটেনি। অন্যের বাড়িতে সারাদিন কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়েছিল। এক কাপড়ে বছর পার করেছি। এরই মধ্যে ঘরবাড়ি হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে যাই। সন্তানদের মুখের দিকে তাকাতে পারতাম না। সেদিনের কথা মনে হলে এখনো কষ্ট হয়। এখন আর ওই অবস্থা নেই। জীবনযাত্রা বদলে গেছে। খুব ভালো আছি।’

 

২০ হাজার টাকায় ব্যবসা শুরু উল্লেখ করে মনোয়ারা বলেন, ‘প্রথমে ইউজিপি থেকে প্রশিক্ষণ শেষে জানতে চাওয়া হয়েছিল, কি ব্যবসা করব। যেহেতু সাগরপাড়ে থাকি সেহেতু মাছ ব্যবসাকে বেছে নিই। তখন ২০ হাজার টাকায় মাছ কিনে দেয়া হয় তাদের পক্ষ থেকে। ওই টাকায় জেলেদের কাছ থেকে বিভিন্ন ধরনের মাছ কিনি। সেগুলো পরিষ্কার করে শুঁটকি বানিয়ে বাজারে ৩০ হাজার টাকায় বিক্রি করি। এভাবে ব্যবসায় আয় শুরু হয়।’

 

মনোয়ারা বলেন, ‘এখন আমার পল্লির শুঁটকি কক্সবাজার শহরে বিক্রি হয়। শুঁটকি তৈরির জন্য দৈনিক পাঁচজন নারী কাজ করেন। এর পাশাপাশি ছাগল, হাঁস-মুরগি পালনসহ জমিতে ধান চাষ করি। আমার সন্তানরা স্কুলে যায়। ব্যবসা করায় আগে লোকে নানা কথা বললেও এখন সম্মান দেয়। সব মিলিয়ে এখন প্রায় দুই লাখের মতো পুঁজি আছে। শুঁটকি উদ্যোক্তা হতে চাই। আমার শুঁটকি যাতে চট্টগ্রামের বড় বাজারে বিক্রি হয় সেই লক্ষ্য ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি।’

 

শাহপরীর দ্বীপ পশ্চিমপাড়ার বাসিন্দাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এই দ্বীপের বাসিন্দারা মানবেতর জীবনযাপন করেন। অধিকাংশ নারীর বিয়ে হয় ১৪-১৫ বছর বয়সে। ৩০ বছর পার হতেই স্বামীরা আবারো বিয়ে করে অন্যত্র চলে যান। কেউ কেউ জীবিকার তাগিদে সমুদ্রপথে মালয়েশিয়ায় পাড়ি জমান। যাওয়ার পথে অনেকে নিখোঁজ হন। এ অবস্থায় সন্তানদের লালনপালন ও ভরণপোষণের দায়িত্ব আসে নারীদের কাঁধে। নিরুপায় হয়ে ক্ষেতে-খামারে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতে হয় তাদের।

 

এসব নারীকে স্বাবলম্বী করার উদ্যোগ নিয়েছে ব্র্যাকের আলট্রা পুওর গ্র্যাজুয়েশন (ইউপিজি)। জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থার অনুদানে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে ব্র্যাক। ইউপিজির প্রকল্প থেকে হতদরিদ্রদের সহায়তা পাইয়ে দেয়া ও বিভিন্নভাবে সহায়তা করছেন শাহপরীর দ্বীপের মাঝেরপাড়ার মো. ইলিয়াছের স্ত্রী রোজিনা আক্তার।

 

রোজিনা আক্তার বলেন, ‘যেসব নারী এখন স্বাবলম্বী তারা আগে হতদরিদ্র ছিলেন। কয়েকজনের স্বামী বিয়ে করে অন্যত্র চলে গেছেন। এক শতাংশ জমিও ছিল না কারও। অন্যের ক্ষেতে কাজ করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। এসব নারী ২০ হাজার টাকার নিয়ে বছর দুয়েক আগে গরু-ছাগল ও হাঁস-মুরগি পালন শুরু করেন। শুরুতে তাদের সহায়তা করেছিল বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘আমরা কাজ করি’। পরিশ্রম করে সেই পুঁজি লাখ টাকার বেশি করেছেন তারা। এখন যে যার মতো ব্যবসা করছেন। সবাই এখন স্বাবলম্বী।’

 

মাঝেরপাড়ার আমির আহমদের মৃত্যুর পর চার সন্তান নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছিলেন স্ত্রী আনোয়ারা বেগম। ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে ইউপিজি প্রোগ্রামে যুক্ত হন আনোয়ারা। পরে সেখান থেকে তাকে ২২ হাজার টাকার একটি গরু দেয়া হয়। এটি বর্তমানে বাছুর দিয়েছে। পাশাপাশি একটি ব্যাংক ৭০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে নিজ ঘরের পাশে মুদি দোকান দেন। এখন ব্যবসা করে ভালোভাবেই চলছে তার সংসার।

 

আনোয়ারা বেগম বলেন, ‘খামারে ৩০০টি মুরগি আছে। দোকান, মুরগি পালন, গবাদিপশু পালন ও শুঁটকি উৎপাদন সবকিছু করতে পারি। এ ছাড়া দুই সন্তানকে ৩০ হাজার টাকা খরচ করে তিনটি জাল কিনে দিয়েছি। তারা সাগরে জাল ফেলে মাছ ধরে বিক্রি করে সংসার চালায়। ছোট দুই সন্তান পড়াশোনা করে। পাশাপাশি দোকানে বেচাকেনা করে। আমরা এখন সুখে আছি।’

 

প্রকল্প ব্যবস্থাপক মোহাম্মাদ কায়সার পারভেজ বলেন, ‘দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়ন ও তাদের স্বাবলম্বী করতে কাজ করছি আমরা। ইউজিপির প্রকল্পের মাধ্যমে সহায়তা দেয়ার মাধ্যমে পিছিয়ে পড়া নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে তৈরি করা হয়। প্রকল্প থেকে তাদের পুঁজি দেয়া হয়। এসব নারী বিভিন্ন ব্যবসা করে প্রথম বছরে লাভ পেয়েছেন। পরের বছর পুঁজি দ্বিগুণ করেছেন।’

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version