-->

হারিয়ে যাচ্ছে চরফ্যাশনের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও সুস্বাদু রস

মামুন হোসাইন, চরফ্যাশন (ভোলা
হারিয়ে যাচ্ছে চরফ্যাশনের ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও সুস্বাদু রস
চরফ্যাশনের একটি গ্রামের খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহ করছেন গাছি। ছবিটি শুক্রবার তোলা

মামুন হোসাইন, চরফ্যাশন (ভোলা): ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার আবহমান গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী খেজুর গাছ ও সুস্বাদু খেজুরের রস-গুড় হারিয়ে যাচ্ছে। এক সময় প্রতিদিন গাছিরা খেজুর রস সংরক্ষণ করার জন্য ঘুরে বেড়াতেন গ্রামের মেঠোপথে। রস আহরণে গাছিরা কোমরে দড়ির সঙ্গে ঝুড়ি বেঁধে ধারালো দা দিয়ে নিপুণ হাতে গাছ চাঁচাছোলা ও নলি বসাতেন। সেই কাজ এখন আর দেখা যায় না। চোখে পড়ে না গ্রামবাংলার সেই চিরচেনা দৃশ্য, তেমনি দুষ্প্রাপ্য হয়ে উঠেছে খেজুরের রসও। খেজুর গাছ হারিয়ে গেলে এক সময় হারিয়ে যাবে খেজুর রস ও খেজুর গুড়ের ঐতিহ্য।

 

একসময় গ্রামের ছোট ছোট বাজারে সারি সারি করে খেজুরের রস নিয়ে বসে থাকতেন গাছিরা। সেই রসের ঘ্রাণ মাছির ভনভন শব্দ এখন আর পাওয়া যায় না। শীত মৌসুমের শুরুতেই গ্রামাঞ্চলে খেজুর রসের ক্ষির, পায়েস ও পিঠে খাওয়ার ধুম আর তেমন চোখে পড়ে না। এখন আর আগের মতো খেজুরের রসও নেই, নেই সে পিঠে পায়েসও। সে সময় সকাল বেলা অনেকের ঘুম ভাঙত খেজুরের রসের মিষ্টি পিঠার সুগন্ধি ঘ্রাণে। পরিবারের সব সদস্য মিলে সকাল বেলা নাস্তা করতেন খেজুর রসের তৈরি সুস্বাদু পায়েস ও বিভিন্ন ধরনের পিঠা দিয়ে। এখন মানুষের কাছে খেজুরের রস ও খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি খাবারগুলো স্বপ্নের মতো মনে হয়।

 

চরফ্যাশন উপজেলার শশীভূষণ, দক্ষিণ আইচা, দুলার হাটসহ বিভিন্ন চরঞ্চলে সুস্বাদু এই খেজুরের রস আগুনে জ্বাল দিয়ে বানানো হতো বিভিন্ন রকমের গুড়ের পাটালি ও নালি গুড়। খেতেও যেমন সুস্বাদু, চাহিদাও ছিল ব্যাপক। কিন্তু কালের বিবর্তনে সেগুলো হারিয়ে যেতে বসেছে।

 

শখের বসত প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো খেজুর গাছ থেকে রস সংগ্রহকারী গাছিদের মতে, আগের মতো খেজুর গাছ না থাকায় এখন আর সেই রমরমা অবস্থা নেই। ফলে শীতকাল এলেই অযত্ন-অবহেলায় পড়ে থাকা গ্রামীণ জনপদের খেজুর গাছের কদর বেড়ে যেত। বর্তমানে এসব অঞ্চলে প্রতি হাড়ি খেজুর রস-গুড় আড়াইশ থেকে ৩শ টাকা বিক্রি হচ্ছে। তাও চাহিদার তুলনায় খুবই কম।

 

গাছিরা বলেন, খেজুর গাছ রক্ষায় বন বিভাগের কার্যকরী পদক্ষেপ না থাকায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে খেজুর গাছ আর শীতের মৌসুমে খেজুর গাছের রস শুধু আরব্য উপন্যাসের গল্পে পরিণত হতে চলেছে।

 

উপজেলার ওমরপুর ইউনিয়নের প্রবীণ গাছি মো. ইসমাইল হোসেন বলেন, আমি দীর্ঘ সতেরো বছর ধরে খেজুর রস ও গুড় বিক্রি করে সংসার চালাতাম। এখন খেজুর গাছ কমে যাওয়ায় খেজুর রস তেমন পাওয়া যায় না। পাঁচ সাত বছর আগে এক কলস রসের হাড়ি বিক্রি করতাম ৮০ থেকে ১০০ টাকা। এখন খেজুর রসের হাড়ি বিক্রি করি ৫০০ টাকা। এরপরও আমার সংসার চালাতে কষ্ট হচ্ছে।

 

চর-কলমী ইউনিয়নের গাছি ওলী মিয়া বলেন, আগে আমাদের দারুণ কদর ছিল। মৌসুম শুরুর আগে থেকেই কথাবার্তা পাকা হতো কার কয়টি খেজুর গাছ কাটতে হবে। কিন্তু আগের মতো তেমন খেজুর গাছও নেই। আর গ্রামের লোকেরাও এখন আর কেউ ডাকে না। গ্রামে অল্প কিছুু গাছ আছে সেগুলো কেটে নিজেদের চাহিদা মিটাই।

 

আরো কয়েকজন প্রবীণ গাছীর সঙ্গে কথা হলে তারা জানান, খেজুর গাছ যেভাবে নিধন হচ্ছে যদি সেভাবে রোপণ না করে, তাহলে কয়েক বছর পর খেজুরের রস গ্রামেও পাওয়া যাবে না। সরকার যদি গ্রামের রাস্তাগুলোর পাশে নতুন করে খেজুর গাছ রোপণে উদ্যোগ নেয় তাহলে মানুষ আগের মতো খেজুরের রস খেতে পারবে বলে আমরা আশা করি।

 

সামাজিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ইয়ুথ পাওয়ার ইন বাংলাদেশের চরফ্যাশন উপজেলা শাখার সভাপতি মনির আসলামী বলেন, খেজুরের রস, রসের পিঠা ও পায়েস খাওয়ার কথা আজও ভুলতে পারি না। এখন তো আর রস চোখেও পড়ে না। সেসব শুধুই স্মৃতি। এ বিষয়ে জানতে চাইলে উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. ওমর ফারুক জানান, মানুষ খেজুর গাছ যেভাবে নিধন করছে সেভাবে রোপণ করেনি। সেজন্য খেজুর রস সংকট দেখা দিয়েছে।

 

ভোরের আকাশ/মি

মন্তব্য

Beta version