-->
শিরোনাম

২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মুক্তাগাছার মণ্ডার স্বাদ বদলায়নি

মীর বাবুল, ময়মনসিংহ
২০০ বছরের ঐতিহ্যবাহী মুক্তাগাছার মণ্ডার স্বাদ বদলায়নি
ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডা এবং মণ্ডার দোকান

মীর বাবুল, ময়মনসিংহ: ‘মণ্ডা’ নামটি মুখে আসলেই ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার মণ্ডার নাম চলে আসে। সারা দেশে বিভিন্ন মিষ্টির দোকানে মণ্ডা পাওয়া গেলেও এখানকার মণ্ডার স্বাদের কথা সবাই বলে। ১৮২৪ সাল থেকে এই সুনাম ধরে রেখেছে এখানকার কারিগররা। মুক্তাগাছার মণ্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল। তার প্রতিষ্ঠিত মণ্ডার দোকানে প্রায় ২০০ বছর ধরে মণ্ডা তৈরির ব্যবসা চলছে বংশানুক্রমে। এখন চলছে পঞ্চম পুরুষের ব্যবসা।

 

তবে মণ্ডার প্রসারের সঙ্গে জড়িয়ে আছেন মুক্তাগাছার জমিদারেরা। মুক্তাগাছা পৌর শহরে জমিদারবাড়ির কাছে পূর্বদিকে রাম গোপাল পাল বা গোপাল পালের মণ্ডার দোকান। সেখানে গিয়ে দেখা যায়, কিছুক্ষণ পর পর ক্রেতা আসছেন মণ্ডা কিনতে। কয়েকজন দোকানের ভেতরে বেঞ্চে বসে মণ্ডা খাচ্ছেন। কেউ আবার মণ্ডার প্যাকেটে করে বাসায় নিয়ে যাচ্ছেন। এভাবে ক্রেতাদের আসা-যাওয়ার মধ্যে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন বিক্রেতারা।

 

ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ শহরে আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে এসেছেন আব্দুল আলিমসহ তার পাঁচ সদস্যের পরিবার। আসল মণ্ডার স্বাদ পেতে তিনি চলে আসেন মুক্তাগাছায়। মণ্ডা কেনার সময় কথা হয় তার সঙ্গে।

 

আব্দুল আলিম বলেন, ‘ময়মনসিংহে যখনই আসি, মুক্তাগাছার মণ্ডা খেয়ে তৃপ্তি পাই। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলায় মণ্ডা পাওয়া গেলেও এই মণ্ডার স্বাদের সঙ্গে মেলে না। ফলে সপরিবারে মণ্ডা খেয়ে ৫৬০ টাকা কেজি দরে ৩ কেজি কিনে বাসায় নিচ্ছি।’

 

মণ্ডার দোকানের পাশ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছিলেন মুক্তাগাছা পৌর এলাকার বয়োবৃদ্ধ জমশের আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদের মুক্তাগাছা উপজেলা সারা দেশে পরিচিতি পেয়েছে এই মণ্ডার কারণে। ঐতিহ্যবাহী এই মণ্ডা একচেটিয়া বিক্রি হয়। ফলে উপজেলাজুড়ে কমপক্ষে ছয় থেকে সাতটি মণ্ডার দোকান গড়ে উঠেছে। তবুও দূর থেকে আসা ক্রেতারা খুঁজে খুঁজে পুরাতন এই দোকানেই চলে আসেন।’

 

জনপ্রতিশ্রুতি আছে, গোপাল পাল স্বপ্নে প্রায়ই এক সাধুর দেখা পেতেন। স্বপ্নে সাধু তাকে মণ্ডা তৈরির নিয়ম শেখাতেন। প্রায় রাতেই সাধু মণ্ডা তৈরির নিয়ম বলতেন। সর্বশেষ এক রাতে মণ্ডা তৈরির শেষ নিয়মটি শেখালেন এবং বললেন, ‘তুই এইমণ্ডার জন্য অনেক খ্যাতি অর্জন করবি। তোরমণ্ডার সুখ্যাতি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়বে।’

 

গোপাল পাল স্বপ্নে মণ্ডা তৈরির পদ্ধতি পেয়ে মণ্ডা বানিয়ে প্রথমেই খাওয়ান মুক্তাগাছার জমিদার সূর্যকান্দ আচার্য চৌধুরীকে। মণ্ডা খেয়ে তৃপ্তি পেয়ে নিয়মিত মণ্ডা দিতে বলেন। মহারাজা সূর্যকান্তের ছেলে শশীকান্তও মণ্ডা খুব পছন্দ করতেন। সেই থেকে আজ অবধি বংশপরম্পরায় মণ্ডা তৈরি হচ্ছে।

 

দোকানে থাকা একটি পুস্তিকা থেকে জানা যায়, মণ্ডার কারিগর গোপাল পাল ১৭৯৯ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার আদি নিবাস মুর্শিদাবাদে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর মুর্শিদাবাদের লোকজন বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়। তখন গোপাল পালের বাবা রাম পাল প্রাণভয়ে পালিয়ে মালদহ হয়ে বর্তমান বাংলাদেশের রাজশাহীতে চলে আসেন। এরপর সেখান থেকে ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার তারাটি গ্রামে নতুন করে বসবাস শুরু করেন।

 

ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গোপাল পালের বংশধররা শরণার্থী হিসেবে ভারতে আশ্রয় নেন। সেখানেও তারা মণ্ডা তৈরি করেন। কিন্তু ভারতের আবহাওয়া বাংলাদেশের মণ্ডার বিশেষ উপযোগী ছিল না। তাই আগের স্বাদ আর হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের পর মুক্তাগাছায় ফিরে এসে সেই একই স্থানে মণ্ডা তৈরি আরম্ভ করেন তারা। ১০৮ বছর পর ১৯০৭ সালে মারা যান সুস্বাদু এই মণ্ডার উদ্ভাবক গোপাল পাল।

 

পাকিস্তান আমলে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, বাংলাদেশের স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দোকানে বসে মণ্ডা খেয়ে সুনাম করেছেন।

 

কথা হয় দোকানের ম্যানেজার আশিষ দাসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘আমি দুই বছর যাবৎ এই মণ্ডার দোকানে চাকরি করি। করোনার সময় কিছুদিন দোকান বন্ধ ছিল। তখনো মণ্ডার স্বাদ নিতে দূর-দূরান্ত থেকে অনেক ক্রেতা দোকানে এসে ফোন দিয়েছেন। এতেই বোঝা যায়, এই মণ্ডার জনপ্রিয়তা কত।’

 

তিনি বলেন, ‘বর্তমানে প্রতিদিন বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে ক্রেতারা এসে মণ্ডা খাওয়ার পাশাপাশি কিনে নিয়ে যাচ্ছেন। মণ্ডা বিক্রি করতে সারা বছর ব্যস্ত সময় পার করি।’

 

গোপাল পালের দোকানটি পঞ্চম বংশধর রমেন্দ্র নাথ পালের মৃত্যুর পর পরিচালনা করছেন রমেন্দ্রর ছোট ভাই রবীন্দ্র নাথ পাল, রথীন্দ্র নাথ পাল, শিশির কুমার পাল ও মহির কুমার পাল।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version