পর্যটন কেন্দ্র কুয়াকাটায় আবাসন সংকটের পাশপাশি চরম অব্যবস্থাপনা বিদ্যমান। এখানে কোনো কোনো বাস টার্মিনাল নেই। পর্যটকদের নিয়ে আসা শত শত বাস রাখা হয় সৈকত থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার দূরে একটি ফসলের মাঠে। ছুটির দিনে যখন লাখো পর্যটকের ভিড় তখন সবাইকে জায়গা দেওয়ার মতো হোটেল-মোটেল নেই এখানে। বাধ্য হয়ে অনেককে রাত কাটাতে হয় খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাড়ির ভেতরে।
এ সুযোগে রেস্টুরেন্টগুলো খাবারের অস্বাভাবিক দাম নিচ্ছে। সংকটের সুযোগ নিচ্ছে এক শ্রেণির আবাসিক হোটেলও। ৩-৪ গুণ বেশি ভাড়া রাখছে পর্যটকদের কাছ থেকে। এসব বিষয়ে প্রশাসনসহ বিভিন্ন দপ্তরে জানিয়েও মেলে না সুফল। ফলে সূর্যোদয়-সূর্যাস্তের সমুদ্রসৈকত কুয়াকাটা বেড়াতে এসে দুর্ভোগের শিকার হন মানুষ।
বাস থেকে নেমেই ভোগান্তি শুরু
স্বপ্নের পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পর থেকেই মূলত কুয়াকাটার প্রতি আকর্ষণ বাড়তে শুরু করে পর্যটকদের। বর্তমানে রাজধানী থেকে সড়কপথে মাত্র ৫ ঘণ্টায় আসা যাচ্ছে কুয়াকাটা। সহজ যোগাযোগ আর একই সৈকতে দাঁড়িয়ে সূর্যোদয় সূর্যাস্ত দেখার দুর্লভ সুযোগের কারণে প্রতিদিনই বাড়ছে পর্যটকের ভিড়। ছুটির দিনগুলোতে যা লাখ ছাড়িয়ে যায়। বিপুলসংখ্যক পর্যটকের ভোগান্তি শুরু হয় বাস থেকে নেমেই।
আগে বাস চলে যেত কুয়াকাটা সৈকতের একেবারে কাছে। এতে যানজটসহ নানা জটিলতা দেখা দিলে নতুন ব্যবস্থা নেয় প্রশাসন। এখন বাস থামানো হচ্ছে সৈকত থেকে প্রায় দেড় কিলোমিটার আগে কচ্ছপিয়া নামক স্থানে।
এখানে সড়কের পাশে বিশাল একটি ধানখেতে পার্কিং করে রাখা হচ্ছে শত শত বাস। সৈকত থেকে দেড় কিলোমিটার আগের এই অস্থায়ী বাস টার্মিনালে নেমে পর্যটকদের রিকশা-ভ্যান কিংবা হেঁটে যেতে হয় সৈকতে। এতে বিপাকে পড়ছেন নারী, বৃদ্ধ এবং শিশুরা।
জানতে চাইলে কুয়াকাটার পৌর মেয়র আনোয়ার হাওলাদার বলেন, ‘১৩ কোটি টাকা ব্যয়ে নয়াপাড়া-তুলাতলী এলাকায় ৫ একর জমিতে বাস টার্মিনাল নির্মাণ হচ্ছে। ২০২২-এর জুনে কাজ শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ঠিকাদার সময় বাড়িয়ে চলতি বছরের জুনে কাজ শেষ করার কথা বলেছেন। নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হলে আর সমস্যা থাকবে না।’
আবাসন সংকট, গলাকাটা মূল্যে সেবা
কুয়াকাটার বর্তমানে ১৫০টির মতো হোটেল-মোটেল রয়েছে। এসব হোটেল-মোটেলে সর্বোচ্চ ১৫ হাজার পর্যটক থাকতে পারেন। ছুটির দিনগুলোতে যখন পর্যটকের সংখ্যা লাখ ছাড়িয়ে যায় তখন হোটেল-মোটেলে জায়গা না পেয়ে পড়তে হয় অবর্ণনীয় দুর্ভোগে। এরকম পরিস্থিতিতে হাজার হাজার পর্যটক বাধ্য হন খোলা আকাশের নিচে কিংবা গাড়ির ভেতর রাত কাটাতে।
কথা হয় এরকম একজন পর্যটক আলতাফ হোসেনের সঙ্গে। স্ত্রী, সন্তান নিয়ে বেড়াতে আসা স্কুল শিক্ষক আলতাফ কোনো হোটেলে সিট না পেয়ে বসেছিলেন সাগর পারের ট্যুরিস্ট বেঞ্চে। ঝালকাঠি থেকে আসা আলতাফ জানান, ‘কয়েকটি আবাসিক হোটেলে গিয়েছিলাম। স্বাভাবিক সময়ে যেখানে ৮শ থেকে হাজার টাকায় রুম পাওয়া যায় সেই রুম এখন চাইছে ৩-৪ হাজার টাকা। খাওয়ার ক্ষেত্রেও একই অবস্থা।
শুধু ডিম, ডাল, ভাত খেতে গেলেও জনপ্রতি খরচ পড়ছে এক থেকে দেড়শ টাকা। এভাবে হলে তো কুয়াকাটায় কেউ আসবে না।’
কুয়াকাটা ট্যুরিজম ম্যানেজমেন্টের সভাপতি নাসির উদ্দিন বিপ্লব বলেন, ‘এসব সমস্যার কারণে চরম বিব্রতকর পরিস্থিতিতে রয়েছি আমরাও। বিশেষ করে যেসব আবাসিক হোটেল খুব একটা মানসম্মত নয় তারাই এভাবে পর্যটক ঠেকিয়ে অতিরিক্ত ভাড়া নেয়। প্রশাসনের কাছে আমরা বলেছি আবাসিক এবং খাবার হোটেলগুলোর দৃশ্যমান স্থানে সেবার মূল্য তালিকা ঝোলানো নিশ্চিত করতে। কিন্তু তা করা হয়নি। যে কারণে পর্যটকদের দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে।’
চরম অব্যবস্থাপনা, নেই নিরাপত্তা কর্মী
জেলা শহর পটুয়াখালী থেকে ৭৫ কিলোমিটার দীর্ঘ সরু সড়ক ধরে পৌঁছাতে হয় কুয়াকাটায়। সৈকতের ২২ কিলোমিটার আগে থাকা কলাপাড়া উপজেলার পর যার প্রস্থ কমে গেছে আরও এক দফা। এই সড়কে লেগে থাকা যানজট পেরিয়ে সৈকতে পৌঁছতে গলদঘর্ম হতে হয়। বিশেষ করে কুয়াকাটা পৌর ভবন থেকে সৈকত পর্যন্ত যেতেই কখনো কখনো লেগে যায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা।
সৈকত থেকে দেড় কিলোমিটার আগে বাস থামলেও পর্যটকবাহী ছোট গাড়ির ভিড় আর অসংখ্য তিন চাকার যানবাহনের কারণে সৃষ্টি হয় এই পরিস্থিতির। জট সামলাতে পৌর কর্তৃপক্ষের নিয়োজিত কর্মী এবং মহিপুর থানার পুলিশ কাজ করলেও তাতে খুব একটা লাভ হয় না। এখানেই শেষ নয়, প্রায় ৩০ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যরে এই সৈকতে নেই সেফ গার্ড বা লাইফ গার্ডের মতো কোনো নিরাপত্তা ব্যবস্থা। স্বল্প পরিসরে থাকা ট্যুরিস্ট পুলিশ নিরাপত্তা দেওয়ার চেষ্টা করলেও তা পর্যাপ্ত নয় বলে অভিযোগ পর্যটকদের।
লিটন মোল্লা নামের স্থানীয় এক যুবকসহ ৮-১০ জন নিজস্ব উদ্যোগে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করেন। ট্যুরিজম অ্যাসোসিয়েশন অব কুয়াকাটার (টোয়াক) সভাপতি রুম্মান ইমতিয়াজ তুষার বলেন, ‘পর্যটক আসার হিসাব করলে এখন কক্সবাজারের পরেই কুয়াকাটা। অথচ এখানে নেই ট্রাফিক পুলিশ। সবচেয়ে বড় সমস্যা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা বলতে কিছুই নেই এখানে।
উপজেলা শহর কলাপাড়া ২২ এবং জেলা শহর পটুয়াখালী ৭৫ কিলোমিটার দূরে। এখানে আছে শুধু একটি পৌরসভা। যে কোনো প্রশাসনিক জটিলতায় আমাদের যেমন ছুটতে হয় ২২ কিংবা ৭৫ কিলোমিটার দূরে তেমনি অতদূর থেকে তারাও এসে সবকিছু করতে পারেন না। কার্যকর একটা প্রশাসনিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা গেলে এসব সমস্যা থাকত না।’
বিচ ম্যানেজন্টে কমিটির সভাপতির বক্তব্য
কুয়াকাটা সৈকতের দেখভাল এবং উন্নয়নসহ অন্যান্য সমস্যা সমাধানের জন্য রয়েছে বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটি। এই কমিটির সভাপতি পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক শরিফুল ইসলাম। তিনি বলেন, ৬ ডিসেম্বর পটুয়াখালীর জেলা প্রশাসক হিসাবে যোগদান করেছি। বিচ ম্যানেজমেন্ট কমিটির সদস্যদের নিয়ে কুয়াকাটায় একটা সভাও করেছি। প্রথমেই আমার যেটা মনে হয়েছে এই পর্যটন কেন্দ্রে পরিকল্পিতভাবে আসলে কিছুই হয়নি।
একটা সময় ছিল পর্যটকের খরায় ব্যবসা-বাণিজ্য গুটিয়ে চলে যাওয়ার মতো অবস্থা হয়েছিল হোটেল-মোটেল মালিকদের। তখন এখানে নতুন করে হোটেল-মোটেল করার আগ্রহ দেখাননি কেউ। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর চেষ্টায় পদ্মা সেতু চালু হওয়ার পরই পর্যটকের ঢল নেমেছে এখানে। আকস্মিক পর্যটকের চাপ সামলানোর মতো সামর্থ্য এখনও গড়ে উঠেনি।
আশার কথা হচ্ছে, অনেক নতুন নতুন বিনিয়োগকারী আসছেন। নতুন নতুন হোটেল-মোটেলের নির্মাণ কাজও চলছে। কক্সবাজার তো একদিনে গড়ে ওঠেনি। এখানেও একটা সময় কোনো সমস্যা থাকবে না। আমরা বর্তমানে উদ্যোগ নিয়েছি সব আবাসিক এবং খাবার হোটেলে সেবার মূল্য তালিকা টানানোর।
এছাড়া সৈকতে একজন ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে একটি টিম নিয়মিত থাকবে। যে কোনো সমস্যায় ব্যবস্থা নেওয়ার পাশাপাশি পর্যটকদের যে কোনো অভিযোগের বিষয়ে উনারা তাৎক্ষণিক আইনি সমাধান দিতে পারবেন। এখানে এসে যাতে কোনো পর্যটক দুর্ভোগে না পড়েন তার সবরকম ব্যবস্থা নিচ্ছি আমরা।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য