-->

চোরাই সিন্ডিকেটের কবলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া

খুলনা ব্যুরো
চোরাই সিন্ডিকেটের কবলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া

সুন্দরবনকে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের জন্য পৃথিবীর সর্বশেষ আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে চড়া মূল্য থাকায় সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া এখন চোরাই শিকারিদের টার্গেটে পরিণত হয়েছে। চোরাই সিন্ডিকেটের কবলে পড়েছে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের চামড়া। ’৮০র দশকে বাঘের চামড়া পাচার শুরু হয়। বিদেশে রয়েছে এর প্রচুর চাহিদা। অদ্যাবধি প্রায় শতাধিক বাঘের চামড়া বনবিভাগসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়েছে। এ ছাড়া লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় গণপিটুনি, বনভূমি উজাড়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, রোগে আক্রান্তসহ নানাবিধ কারণে সুন্দরবনের বাঘ বিপন্ন প্রায়।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, সুন্দরবনের চারটি রেঞ্জ সংলগ্ন গ্রামগুলোতে একাধিক সংঘবদ্ধ বাঘ শিকারি রয়েছে। এদের অবস্থান হচ্ছে- বরগুনা জেলার পাথরঘাটা উপাজেলা চরদোয়ানি, খুলনা জেলার পাইকগাছা ও কয়রা উপজেলা। পূর্ব বিভাগের বাগেরহাট জেলার মোংলা, মোরেলগঞ্জ, শরণখোলা। পশ্চিম বিভাগে সাতক্ষীরা জেলার আশাশুনি, কালীগঞ্জ, শ্যামনগর। এসব অঞ্চলে বাঘ শিকারিরা জেলে সেজে অনুমতিপত্র সংগ্রহ করে গভীর অরণ্যে প্রবেশ করে। এরপর শুরু হয় তাদের অমানবিক সব কার্যকলাপ। তারা খাদ্যে বিষ মিশিয়ে, ফাঁদ পেতে বন্দুক দিয়ে গুলি করে বাঘ হত্যা করে থাকে। শিকারের পর স্থানীয় পদ্ধতি অবলম্বন করে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করা হয়। পরবর্তীতে বিশেষ পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করে লাখ লাখ টাকার বিনিময়ে পাচারকারী চক্রের হাত বদল হয়ে পৌঁছে যায় আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এ অঞ্চলে বাঘ হত্যাকারী চক্রের কাছে বাঘ হত্যা করা সময়ের ব্যাপার হলেও তার চামড়া আন্তর্জাতিক বাজারে এক একটা আট থেকে দশ লাখ টাকা বিক্রি হয়ে থাকে।

 

সূত্র জানায়, প্রথমে আঞ্চলিক চোরাই শিকারিরা বাঘ শিকার করে অতি গোপনে অভ্যন্তরীণ ভিআইপি চোরাই শিকারিদের কাছে রাজধানী ঢাকা অথবা চট্টগ্রামে পৌঁছে দিলেই একেকটি বাঘের চামড়ার বিনিময়ে তারা পেয়ে যায় ১-২ লাখ টাকা। পরবর্তীতে প্রশাসনের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ভিআইপি চোরাকারবারিদের হাত বদল হয়ে এই চামড়া যখন আন্তর্জাতিক বাজারে পৌঁছে যায় তখন এর একেকটি চামড়া বিক্রি হয়ে থাকে ৮-১০ লাখ টাকায়।

 

২০০৩ সালের ৫ অক্টোবর খুলনার একটি গ্লোবাল টাইগার ফোরাম এর সভা শেষে বিশ্বের কয়েকটি দেশে প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে জানানো হয় পৃথিবীর অন্তত ৪০টি দেশে কালো বাজারে বাঘের চামড়া বেচাকেনা হয়ে থাকে। পাচারকারীরা অতি গোপনে ঢাকা কিংবা চট্টগ্রামে বাঘের চামড়া নিয়ে গেলে সেখান থেকে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর চোখে ধুলো দিয়ে আন্তর্জাতিক চোরাকারবারিদের ডেরায় পৌঁছে দেয়।

 

গত ২৫ বছরে প্রায় শতাধিক বাঘের চামড়া আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। কিন্তু ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে পাচারকারী চক্রের রাঘববোয়ালরা। বন্দর নগরী চট্টগ্রাম ও ঢাকা কেন্দ্রে এসব রাঘববোয়ালেরা তাদের সেকেন্ড ইন কমান্ডের মাধ্যমে খুলনা, বাগেরহাট, যশোর, সাতক্ষীরা, পিরোজপুর হতে বাঘের চামড়া সংগ্রহ করে।

 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ঢাকা ও চট্টগ্রাম কেন্দ্রের কয়েকটি অভিজাত হোটেলে এসব চামড়া বেচাকেনা হয়। সেখানে পাচারকারী ছাড়াও তাদের গডফাদারদের প্রতিনিধিরা উপস্থিত থাকে। চট্টগ্রামকেন্দ্রিক চামড়া পাচারকারীরা ইঞ্জিনচালিত নৌকায় করে বার্মা ও ভারতে এসব চামড়া পাচার করে এবং আর্থিক লেনদেন হয় গভীর সমুদ্রের মাঝে।

 

জানা গেছে, সুন্দরবনের ইতিহাসে গত ২৭ বছরে বাঘ বাড়েনি। বরং আশঙ্কাজনক হারে কমেছে। চোরাই শিকারিদের তৎপরতা ও প্রাকৃতিক কারণে সুন্দরবনে প্রতি বছর গড়ে দুটি করে বাঘ মারা যায় বলে এক গবেষণায় দেখানো হয়েছে। সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকার অসাধু শিকারিরা ফাঁদ ব্যবহার করে, ক্লোরোফরম দিয়ে, বিষের টোপ দিয়ে এবং গুলি করে বাঘ হত্যার করেছে খোদ বনবিভাগ কর্মকর্তাদের সামনে। বাঘের চামড়া, হাড়, দাঁত বেশি মূল্যে বিক্রি হয় বলে অনেক বেশি বাঘ শিকার করা হচ্ছে বলে একটি সূত্রে জানায়। প্রতি বছর বাঘ শিকারিদের হাতে ১০-১২টি বাঘ মারা পড়ছে। এর মধ্যে সুন্দরবন বিভাগেই প্রতি বছর ৪-৫টি বাঘ হত্যা করা হয়। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন তাদের নিবন্ধে উল্লেখ করে, স্বাধীনতার পর ২০০০ সাল পর্যন্ত বিভিন্নভাবে অন্তত ১২০টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে।

 

সুন্দরবন বনবিভাগের রেকর্ড অনুযায়ী, ১৯৮০ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত ৫৩টি বাঘ হত্যা করা হয়েছে। ১৯৮১, ৮২, ৮৫, ৮৭, ৯৪ ও ৯৫ সালে সুন্দরবনে কোনো বাঘ মৃত্যুর ঘটনা নেই। এ ছাড়া ১৯৮৩ সালে ৩টি, ১৯৮৬ সালে ২টি, ১৯৮৮ সালে ১টি, ১৯৯০ সালে ২টি, ১৯৯১ সালে ৪টি, ১৯৯২ সালে ১টি, ১৯৯৩ সালে ৪টি, ১৯৯৬ সালে ৫টি, ১৯৯৭ সালে ৮টি, ১৯৯৮ সালে ২টি, ১৯৯৯ সালে ৪টি, ২০০০ সালে ৫টি, ২০০১ সালে ১টি, ২০০২ সালে ৩টি, ২০০৪ সালে ৪টি, ২০০৫ সালে ৬টি এবং ২০০৭ সালে সবচেয়ে বেশি ৮টি বাঘের প্রাণহানি হয়েছে।

 

বনবিভাগ আরো জানায়, বর্তমান সময়ে শরণখোলা, সাতক্ষীরা ও খুলনা রেঞ্জে বাঘ শিকারের ঘটনা সবচেয়ে বেশি। জানা যায়, সবচেয়ে বেশি বাঘের প্রাণহানি ঘটে গণপিটুনিতে। এ ছাড়া বাঘ হত্যার পেছনে বনবিভাগ কর্মকর্তা, বাঘ বিশেষজ্ঞ ও সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকায় মানুষ আটটি কারণ নির্বাচন করেছেন। যার মধ্যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ, লবণাক্ততা (লবণাক্ততায় বাঘ লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত হয়) বনের ঘনত্ব কমে যাওয়ায়, খাদ্য খুঁজে লোকালয়ে ঢুকে পড়ায় গণপিটুনির কথা উল্লেখ করা হয়। স্বভাবগত কারণে পুরুষ বাঘ কর্তৃক বাচ্চা খেয়ে ফেলা, ফাঁদ পেতে কিংবা টোপ দিয়ে অজ্ঞান করার মাধ্যমেও বাঘ মেরে ফেলা হয়।

 

পরিবেশ ও বন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৯৬৩ সালে বন্যপ্রাণি বিশেষজ্ঞ গাই মাউন্ট ফোর্টের হিসাব মতে, তখন সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ১০০। ১৯৭৫ সালে ইউরোপীয় বাঘ বিশেষজ্ঞ হেন্ডরিস সুন্দরবনে বন্যপ্রাণি শুমারি করেন। ওই শুমারিতে তার হিসাব মতে, বাঘের সংখ্যা ছিল ৩৫০। ১৯৯১ সালে একটি বিদেশি সংস্থা জরিপ চালিয়ে ৪৫৯টি বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করেন। ১৯৯৩ সালে তামাং নামাক বিশেষজ্ঞের ধারণা অনুযায়ী, ৩৬২টি বাঘ রয়েছে সুন্দরবনে। ১৯৯৪ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী ৩৬৯টি, ১৯৯৩ সালের বন্য জরিপের সংখ্যা ৩০০ থেকে ৪৭৯টি, কিন্তু বন্য জরিপে ১৯৯২ সালে ছিল ৪৫৩টি। ১৯৯ সালের জানুয়ারি মাসে ব্রিটিশ বিশেষজ্ঞ টিনা ম্যাগগ্রেগর জানান, বাংলাদেশের সুন্দরবনে ২০০টির বেশি বাঘ নেই। সর্বশেষ ২০০৪ সালে ২৬ ফেব্রুয়ারি থেকে ৩ মার্চ পর্যন্ত জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) অর্থায়নে ‘পাগ মার্ক’ বা পায়ের ছাপ গণনা পদ্ধতিতে বাংলাদেশ, ভারত, যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত বাঘ শুমারি অনুযায়ী বাংলাদেশের সুন্দরবন অংশে ৪১৯টি পূর্ণ বয়স্ক বাঘ রয়েছে। যার মধ্যে পুরুষ বাঘ ১২১টি, স্ত্রী বাঘ ২৯৮টি ও বাচ্চা বাঘের সংখ্যা ছিল ২১। অপরদিকে ভারতের সুন্দরবন অংশে পূর্ণ বয়স্ক বাঘ ছিল ২৭৪টি, তন্মাধ্যে পুরুষ ২৪৯টি, স্ত্রী বাঘের সংখ্যা ছিল ২৫। বর্তমানেও সুন্দরবনে বাঘ শুমারি পরিচালিত হচ্ছে বলে বনবিভাগের একাধিক সূত্র জানিয়েছে।

 

এ বিষয়ে কথা হয় খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেনের সঙ্গে। তিনি জানান, লোকালয়ে বাঘ প্রবেশে হত্যা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পুরুষ বাঘ কর্তৃক বাচ্চা খেয়ে ফেলা, অতি মাত্রায় লবণাক্ততা ও চোরাই শিকারিদের দৌরাত্ম্যের কারণে আমাদের সুন্দরবনের বাঘ দিন-দিন কমছে। তিনি দাবি করেন, সুন্দরবনের দায়িত্বরত বনরক্ষীরা চোরাই শিকারিদের প্রতি সার্বক্ষণিক সজাগ দৃষ্টি রাখছে। তার পরও চোরাই শিকারিরা বনরক্ষীদের চোখ ফাঁকি দিয়ে বাঘ, চিত্রা হরিণ শিকার করে যাচ্ছে প্রতিনিয়ত।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version